Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Education

মিছিল করে স্কুলে ভর্তি হল পরিযায়ী শ্রমিকের ছেলেমেয়েরা

ছেলেমেয়েদের শৈশব কাটে ইটভাটার ছাই-মাটি মেখে। জিরাটের একটি ইটভাটার ওই শিশুদের সোমবার প্রশাসনিক উদ্যোগে স্কুলে ভর্তি করানো হল। দাবি উঠল, এই উদ্যোগ দেশে মডেল হওয়া উচিত।

দলবেঁধে: স্কুলে ইটভাটার শিশুরা। ছবি: বিশ্বজিৎ মণ্ডল

দলবেঁধে: স্কুলে ইটভাটার শিশুরা। ছবি: বিশ্বজিৎ মণ্ডল

প্রকাশ পাল
জিরাট শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৩ ০৬:৩৫
Share: Save:

ধুলোমাখা গা। উলোঝুলো চুল। কারও পায়ে সস্তার চটি। অনেকের খালি পা। পিঠে ব্যাগ। তাতে খানকতক বই-খাতা। কারও বয়স চার, কারও ছয়, কারও নয়। মিছিল থামল জিরাট হাটতলায় আশুতোষ স্মৃতি মন্দির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে। মিছিলকারীরা ভর্তি হল সেখানে।

ওদের বাবা-মা ‘পরিযায়ী শ্রমিক’। ছেলেমেয়েদের শৈশব কাটে ইটভাটার ছাই-মাটি মেখে। জিরাটের একটি ইটভাটার ওই শিশুদের সোমবার প্রশাসনিক উদ্যোগে স্কুলে ভর্তি করানো হল। দাবি উঠল, এই উদ্যোগ দেশে মডেল হওয়া উচিত।

উদ্যোগের নেপথ্যে রয়েছেন বলাগড় বিজয়কৃষ্ণ মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক পার্থ চট্টোপাধ্যায়। মাস কয়েক আগে কলেজের জাতীয় সেবা প্রকল্পের (এনএসএস) স্বেচ্ছাসেবক এবং জিরাট কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েক জন প্রাক্তন ছাত্রকে নিয়ে তিনি ওই ইটভাটায় বাচ্চাগুলিকে পড়ানো শুরু করেন। খোলা আকাশের নিচে প্লাস্টিক বিছিয়ে ক্লাস। নাম দেওয়া হয়— ‘বিপ্লবী ভূপতি মজুমদার পাঠশালা’। দুপুরে কোনও দিন ভাত, কখনও মুড়ি-চানাচুর জোগাড় হয়। সম্প্রতি হয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। সর্ষে খেতের পাশে শিশুদের বিস্কুট দৌড়, মোরগ দৌড়, মিউজ়িক্যাল চেয়ার, কমলালেবু দৌড় দেখতে যান বিডিও (বলাগড়) নীলাদ্রি সরকার। এর পরেই তাদের স্কুলে ভর্তির জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু। প্রশাসনের তরফে বই-খাতা, ব্যাগ, জুতো দেওয়া হয়।

সোমবার ৫৮ জন স্কুলে ভর্তি হল। ২৬ জন প্রথম শ্রেণিতে। বাকিরা প্রাক প্রাথমিকে। ইটভাটা থেকে মিছিল করে বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে এলেন বলাগড় কলেজের অধ্যক্ষ প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায়, জিরাট কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুল শরীফ শেখ, জিরাট পঞ্চায়েতের উপপ্রধান অশোক পোদ্দাররা। স্কুলের খাতায় প্রত্যেকের অভিভাবক হিসাবে সই করেন পার্থ।

বিডিও, অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক গৌরব চক্রবর্তী, সমাজকর্মী বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন। পরিযায়ী শ্রমিকের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছেন বিশ্বজিৎবাবু। তিনি বলেন, ‘‘অনেক ইটভাটাতেই কিছু সংগঠনের তরফে বাচ্চাদের পড়ানো হয়। এখানে প্রশাসন এগিয়ে আসায় ওরা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেল। গোটা দেশে এই ব্যবস্থা মডেল হওয়া উচিত।’’ বিডিও জানান, ব্লকের অন্যান্য ইটভাটার শিশুদেরও স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করা হবে।

স্কুলে এসে রোমিশা কুমারী বলে, ‘‘ইধার পড়নে আয়ে হ্যায়। পড়না আচ্ছা লগতা হ্যায়।’’ পূজা খাতা ভর্তি করে হোমওয়ার্ক করতে ভোলে না। চক্রধরপুর থেকে আসা জুরিয়া বোদরার তিন ছেলেমেয়েই স্কুলে গিয়েছে।

বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ায় শ্রমিকরা খুশি। মাটি লেপা চৌখুপ্পি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সে কথাই বলছিলেন তাঁরা। মোগলি দেবী আর তাঁর স্বামী পুকুন ভাটার শ্রমিক। বাড়ি ঝাড়খণ্ডের চাঁইবাসায়। বড় মেয়ে সেখানে ফাইভে পড়ে। ছেলের বয়স নয়। সে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে। সে পা রাখল স্কুলে। মোগলি বলেন, ‘‘এত দিন ছেলের পড়ার সুযোগ ছিল না। এ বার হল। ভালই হল।’’

ইটভাটা শ্রমিকের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর কাজে যুক্ত, এমন অনেকের বক্তব্য, পরিযায়ী শ্রমিকদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা আগেও হয়েছে। ফলপ্রসূ হয়নি। আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কারণে তারা দ্রুত স্কুলছুট হয়। অনেকেই সাঁওতাল, হিন্দিভাষী। মাতৃভাষায় পড়ানোর ব্যবস্থা না থাকলে, উদ্দেশ্য কতটা সফল হবে, সেই প্রশ্নও উঠছে। প্রশাসনের বক্তব্য, সবে প্রথম ধাপ শুরু হল। সমস্যা বুঝে সমাধানের চেষ্টা করা হবে। প্রধান শিক্ষক মহাদেব শীল জানান, ভাষার সমস্যা মিটিয়ে ওই শিশুদের বোঝানোর যথাসাধ্য চেষ্টা তাঁরা করবেন।

পার্থ জানান, বাচ্চারা স্কুলে গেলেও পাঠশালা উঠে যাচ্ছে না। রবিবার পাঠশালা বসবে। লেখাপড়ার সঙ্গে নাচ, গান, কবিতা, যোগাসন, আঁকার তালিম নেবে পরিযায়ী শ্রমিকের সন্তান।

অন্য বিষয়গুলি:

Education school
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy