গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
তৃণমূল থেকে আগত নেতাদের ‘ওয়্যাগ’ নিয়ে নাজেহাল বিজেপি। কিন্তু তবু হাল ছাড়তে নারাজ তারা। শোভন চট্টোপাধ্যায়-বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় জুটিকে নির্বাচনের কাজে লাগাতে মনস্থির করে ফেলেছে দল। ফলে সোমবারের বাইক র্যালিতে শোভন-বৈশাখী তাঁদের না আসার পিছনে যে ‘অসুস্থতা’-র কারণ দেখিয়েছেন, তাকে মান্যতা দিতে চায় রাজ্য তথা কেন্দ্রীয় বিজেপি। দলের পক্ষে এমনও দাবি করা হচ্ছে যে, সত্যিই দু’জন অসুস্থ ছিলেন। ভুবনেশ্বর থেকে কলকাতা— প্রায় সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার পথ গাড়িতে এসে শ্রান্ত, ক্লান্ত এবং অবসন্ন ছিলেন তাঁরা। তার পরে আবার বাইক র্যালির ‘ধকল’ নিতে না পারার জন্যই না কি অনুপস্থিতি। তবে কি রবিবার মধ্যরাত পর্যন্ত শোভনের গোলপার্কের বাড়িতে বৈঠক ও বৈশাখীর গোসার কথা ভুলে যেতে চাইছে গেরুয়া শিবির? আপাতত মুখে কুলুপ রাজ্যনেতাদের।
এই ‘কুলুপ’ এঁটে থাকাটাও দলেরই নির্দেশে। তৃণমূল বিধায়ক জিতেন্দ্র তিওয়ারিকে নিয়ে জল্পনার সময়ে মুখ খুলে সায়ন্তন বসু, অগ্নিমিত্রা পালদের শো-কজের নিদর্শন এখনও টাটকা। তাই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না কেউই। তবে আড়ালে কথা বলতে আর কে বাধা দিচ্ছে! সেই সূত্রেই জানা যাচ্ছে, ‘বরফ’ গলেছে। কিন্তু কী ভাবে? তারও আগেও প্রশ্ন— সোমবার কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়কে যে ভাবে ‘বিব্রত’ হতে হয়েছে, তার পরেও শোভন-বৈশাখীকে সঙ্গে নিতে এখনও কেন এত আগ্রহ বিজেপি-র? দলীয় সূত্রের খবর, অমিত শাহের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে— নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ে কোনও শক্তিকেই দূরে রাখা যাবে না। দলের ছোট-বড় সব নেতাকে কাজে লাগাতে হবে। যথাযুক্ত সম্মান দিয়ে কাজে লাগাতে হবে অন্যান্য দল থেকে আসা নেতা-কর্মীদেরও। তাই কে গোসা করেছেন, কে বেসুরো গাইছেন, সে সব মনে রাখলে চলবে না।
সেইমতোই মঙ্গলবার সকাল থেকে শুরু হয়েছিল মান ভাঙানোর পালা। বস্তুত, সেটা শুরু হয়ে গিয়েছিল সোমবার রাত থেকেই। এক দিকে যখন রাজ্য বিজেপি দফতরে শোভন-বৈশাখীর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে তালা ঝোলানো হচ্ছিল, তখন পাশাপাশিই শুরু হয়েছিল দৌত্য। ‘অসুস্থতা’ তত্ত্বকে মান্যতা দিয়ে প্রথমে বৈশাখী ও পরে শোভনের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিতে শুরু করেন ওই কাজের জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা। প্রথমে জানা গিয়েছিল বৈশাখী অসুস্থ। পরে আবার জানা যায়, শোভনের গায়েও জ্বর ছিল। জানান বৈশাখীই। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে এই জুটির সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রাখছিলেন কেন্দ্রীয় সহ-পর্যবেক্ষক অরবিন্দ মেনন। মঙ্গলবার তিনি জেপি নড্ডার সফরের প্রস্তুতি দেখতে বর্ধমানে ছিলেন। বিজেপি সূত্রে খবর, তাঁর হয়ে শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন রাজ্য বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক (সংগঠক) অমিতাভ চক্রবর্তী। রাজ্য বিজেপি-র এক নেতার বক্তব্য, ‘‘মেনন’জি বর্ধমানে থাকলেও ফোনে কথা বলায় তো কোনও সমস্যা ছিল না!’’ এবং সেই কথাতেই বরফ গলে। তারই রেশ ধরে পরিকল্পনা মাফিক মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সংবাদমাধ্যমের সামনে মিছিলে না থাকার জন্য ক্ষমা চেয়ে ‘কারণ’ ব্যাখ্যা করেন শোভন-বান্ধবী বৈশাখী। বলেন, ‘‘মিছিলে যেতে পারলে খুব আনন্দ হত। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণেই যেতে পারিনি। বিকেল তিনটের সময় একবার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করেছিলাম। কোনও ভাবে যদি রেডি হয়ে বেরোন যায়। কিন্তু শোভনবাবুরও ১০০ মতো জ্বর ছিল সারাদিন। তা সত্ত্বেও উনি চেষ্টা করেছিলেন, ১০ মিনিটের জন্যও যদি যাওয়া যায়! কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণেই যাওয়া হয়ে ওঠেনি।’’
বরফ এতটাই গলে যে, কলকাতা জোনের কমিটিতে বৈশাখীর সম-মর্যাদা অর্থাৎ সহ-আহ্বায়ক পদে যে শঙ্কুদেব পন্ডাকে রাখা নিয়ে আপত্তি ছিল, তাঁকেই বাড়িতে ডেকে নেন শোভন-বৈশাখী জুটি। শুধু বৈঠকে ডাকাই নয়, গভীর রাত পর্যন্ত কলকাতা জোন নিয়ে আলোচনার শেষে শঙ্কুদেবকে ‘দুটি ডাল-ভাত’ খাইয়ে তবেই ছেড়েছেন শোভন-বান্ধবী। সঙ্গে আলু-পোস্ত, পাবদা মাছের ঝোলও ছিল। সূত্রের খবর, বুধবার রাতের বৈঠকে শঙ্কুদেব ছাড়াও ডাকা হয়েছিল কলকাতা জোনের আহ্বায়ক দেবজিৎ সরকারকে। ছিলেন বিজেপি-র উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার দুই সভাপতি শিবাজি সিংহ রায় এবং শঙ্কর শিকদার। বিজেপি সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাতের বৈঠক দেখে বোঝাই যায়নি, রবি ও সোমবারে আদৌ কিছু হয়েছিল! একের পর এক দলীয় কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেন শোভন-বৈশাখী। ঠিক হয়, কলকাতা জোনের অন্যান্য নেতাকে নিয়েও একে একে বৈঠক করবেন তাঁরা। বুধবার রাতেও একটি বৈঠক ডেকেছেন শোভন। তবে আপাতত সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে বসেই কাজ করবেন শোভন। একটু সুস্থ হলে অভিমান-ভোলা জুটি আসবেন বিজেপি-র রাজ্য দফতরে। আবার খোলা হবে তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরের তালা।
মঙ্গলবার রাতের বৈঠক নিয়ে অবশ্য দেবজিৎ বা শঙ্কুদেব কোনও কথা বলতেই রাজি নন। দেবজিতের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, ‘‘আমাদের জোনে ৫১টা বিধানসভা। তার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।’’ আর ‘রাজনৈতিক পরিপক্কতা’ দেখিয়ে শঙ্কুদেব বলছেন, ‘‘রাজনীতি আবেগের জায়গা। মান-অভিমান তো আবেগেরই অঙ্গ। ও সব মাথায় রাখতে নেই। এখন আমাদের লক্ষ্য বিধানসভা নির্বাচনে জিতে দলকে ক্ষমতায় আনা। সেটাই করছি। শোভনদা-বৈশাখীদি যেমন বলবেন তেমন কাজ করাটাই আমার কাজ।’’
তবে কি মধুরেণ সমাপয়েৎ? যবনিকা পড়ে গেল শোভন-বৈশাখী নাট্যে? রাজ্য বিজেপি-র নেতারা এখনও ততটা বলছেন না। তাঁদের একজনের বক্তব্য, ‘‘এত তাড়াতাড়ি শেষ অঙ্ক বলা যাবে না। অমর প্রেম তো আর এই প্রথমবার ধাক্কা দিল না! এখনও অনেক পথ বাকি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy