সুবোধ সিংহ। —নিজস্ব চিত্র।
ডাকাতির ব্লু প্রিন্ট তৈরি হত বিহারের জেলেই। নিজেই সব ছক কষতেন গ্যাংস্টার সুবোধ সিংহ। আর সেই মতোই যে ‘অ্যাকশন’ চলত, এত দিনে তা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে সিআইডির আধিকারিকদের কাছে। কিন্তু তা কী ভাবে সম্ভব হত, এই প্রশ্নই দীর্ঘ দিন ধরে কুরে কুরে খেয়েছে তদন্তকারীদের। শুধু তা-ই নয়, সুবোধের দলের অনেকেই এত দিনে গ্রেফতার হয়েছেন। তা সত্ত্বেও জেলে কী ভাবে লোক জোগাড় করছিলেন গ্যাংস্টার, এই প্রশ্নও রাজ্য পুলিশে দুঁদে গোয়েন্দাদের ভাবিয়েছে। সেই সুবোধ এ বার হাতে আসায় ধীরে ধীরে সেই সব প্রশ্নের উত্তর মিলতে শুরু করেছে।
আসানসোলের রানিগঞ্জে ডাকাতি ও গুলিকাণ্ডের তদন্তে রবিবারই বিহারের বেউর জেল থেকে সুবোধকে রাজ্যে নিয়ে এসেছে সিআইডি। তাঁকে আসানসোল আদালতে হাজিরও করানো হয়। বিচারক আপাতত সুবোধের এক দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। সোমবার তাঁকে ফের আদালতে হাজির করানো হবে। চলতি মাসেই রানিগঞ্জ ও হাওড়ার ডোমজুড়ে সোনার দোকানে ডাকাতি হয়। দু’টি ঘটনাতেই নাম জড়ায় সুবোধের। পুলিশ সূত্রে খবর, তদন্তে উঠে এসেছে, রানিগঞ্জে ডাকাতির ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন সোনু সিংহ। তিনি সুবোধের দলেরই সদস্য। সোনু-সহ পাঁচ জনকে গ্রেফতারও করা হয়। অন্য দিকে, ডোমজুড়ের ঘটনায় কেউ গ্রেফতার না হলেও তদন্তকারীদের দাবি, এর নেপথ্যে রয়েছে বিকাশ ঝা নামে বিহারের সমস্তিপুরের এক দুষ্কৃতী ও তার দল। সুবোধই যার মাথায় রয়েছেন। শুধু এই দুই ডাকাতির ঘটনাই, এর আগেও রাজ্যের কয়েকটি সোনার দোকান ও স্বর্ণ ঋণ সংস্থার অফিসে ডাকাতির অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। অনেক দিন ধরেই তদন্তকারীরা সুবোধকে এ রাজ্যে নিয়ে এসে জেরা করতে চাইছিলেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। শেষ পর্যন্ত সুবোধ নাগালে আসায় এ বার তদন্তকারীদের বিশ্বাস, এ বার সব ক’টি ঘটনারই কিনারা করা সম্ভব হবে।
সিআইডির একটি সূত্রে খবর, তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, বরাবরই সোনার প্রতি নজর ছিল সুবোধের। সেই কারণে সারা দেশে এখনও পর্যন্ত কম করেও ১৫টি সোনার দোকান ও স্বর্ণ ঋণ সংস্থায় ডাকাতি করেছেন তিনি। যার জেরে জেলে তাঁর নামও হয়ে গিয়েছে ‘গোল্ডেন ডাকু’। পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল, ব্যারাকপুর, কলকাতা, পুরুলিয়া, রানাঘাট, টিটাগড় ও হাওড়ায় ডাকাতির ঘটনায় তাঁর নাম জড়িয়েছে। এ ছাড়া জয়পুর, চেন্নাই, ছত্তীসগঢ়, ওড়িশা ও মহারাষ্ট্রেও ডাকাতিকাণ্ডের তদন্তে সুবোধের নাম উঠে এসেছে।
তদন্তকারীদের সূত্র জানাচ্ছে, সুবোধ মূলত একটি স্বর্ণ ঋণ সংস্থাকেই নিশানা করে এসেছেন এত দিন ধরে। কোনও শহরে ওই সংস্থার যে শাখায় ডাকাতি হবে বলে স্থির হয়, গ্যাংয়ের এক সদস্য নাম পরিবর্তন করে তার আশপাশেই কোথাও ঘর ভাড়া নেন। স্পষ্ট নির্দেশ থাকে যে, কোনও হোটেলে থাকা যাবে না। ঘর ভাড়া নেওয়ার পর সাত-আট দিন ধরে সংস্থার অফিসে রেকি চলে। সব তথ্য জোগাড় করা হয়ে গেলে তৈরি হয় ব্লু প্রিন্ট। ডাকাতির ছক কষা হয়ে যাওয়ার পরেই গ্যাংয়ের বাকি সদস্যদের ডেকে নেওয়া হয় ওই এলাকায়। তার পর স্থির হয় দিন ক্ষণ। ডাকাতির দিনে সাত-আট জন অফিসার সেজে সংস্থার অফিসে প্রবেশ করেন। তার পর বন্দুক দেখিয়ে শুরু হয় লুট। ডাকাতির পর তাঁরা শহরও ছাড়েন না। কয়েক দিন ওই এলাকাতেই থাকেন। এলাকা ঠান্ডা হওয়ার পরেই তাঁরা সেখান থেকে যান।
বিভিন্ন সূত্র থেকে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, সুবোধের কোনও স্থায়ী গ্যাং নেই। কয়েক জন কাছের সাঙ্গোপাঙ্গ রয়েছেন ঠিকই। তাঁরাও বিহারের জেলেই রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ সশরীরে ডাকাতি করেন না। ব্লু প্রিন্ট তৈরিতেই সুবোধকে সাহায্য করেন তাঁরা। প্রতি বারই ডাকাতির ভিন্ন ভিন্ন দল তৈরি হয়। আর সেই দল তৈরি হয় জেলে নতুন আসা চোর ও ডাকাতদের নিয়েই। জেলে সে রকম কেউ এলেই তক্কে তক্কে থাকতেন সুবোধ ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা। নজর রাখা শুরু হত তাঁর উপর। পছন্দ হলেই তাঁকে ভিআইপি সুবিধা দেওয়া হত কারাগারে। তার পর চলত মগজধোলাই। এ ভাবেই প্রচুর ছোটখাটো অপরাধী সুবোধের দলে যোগ দিয়েছেন। গ্যাংয়ে যোগ দেওয়া মাত্রই সুবোধ তাঁদের জামিনের ব্যবস্থা করতেন। তার পর চলত প্রশিক্ষণ— কী ভাবে ডাকাতি করে সুবোধের গ্যাং, পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলে কী করতে হবে, ধরা পড়লে পুলিশকে কী বলতে হবে ইত্যাদি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy