প্রিয়শঙ্কর বাগ। নিজস্ব চিত্র।
আর্থিক অনটন তো আজন্মের প্রতিবন্ধক। তদুপরি করোনাকালে সেই বাধার দোসর হয়ে উঠেছিল ‘ডিজিটাল ডিভাইড’। অতিমারির দীর্ঘ সময়ে অনলাইনে শিক্ষার ব্যবস্থা হলেও মসৃণ ইন্টারনেট পরিকাঠামোর অভাবে গ্রামবাংলার হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে যে-ভাবে ভুগতে হয়েছে ও হচ্ছে, পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের সওয়াই গ্রামের প্রিয়শঙ্কর বাগ তাঁদেরই এক জন। তবু তিনি আলাদা। অনটন আর ডিজিটাল ডিভাইডের জোড়া প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি পেয়েছেন প্রিয়শঙ্কর। হয়ে উঠেছেন দৃষ্টান্ত।
গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে সাইবার ক্যাফেতে বসে রোজ ম্যানেজমেন্টের অনলাইন ক্লাস করতেন প্রিয়শঙ্কর। ইন্টারভিউও দেন এক সাইবার ক্যাফেতে বসেই। অভাবী পরিবার থেকে এত বড় চাকরি পেতে তাঁকে যে-দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে, সেটা তো উদাহরণ বটেই। সেই সঙ্গে এটা যে অতিমারির এই দুঃসময়ে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’-কে জয় করারও অনন্য উদাহরণ, মানছে শিক্ষা শিবির।
বাবা কালীশঙ্কর বাগ ভাগচাষি। প্রিয়শঙ্করও বাবাকে চাষের কাজে সাহায্য করেন। ম্যানেজমেন্ট পড়ার ফাঁকেও করেন। অভ্যাসটা আজকের নয়। খেতে কাজ করতে করতেই প্রিয়শঙ্কর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন। পাশ করে চাকরিও পান। পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চাকরি তখন দরকার। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রি কোর্সের প্রবেশিকা দিয়ে সফল হন। তাই চাকরির চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বহরমপুর গভর্নমেন্ট কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেক্সটাইল টেকনোলজিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করেন। পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করবেন, না ম্যানেজমেন্ট পড়বেন— এই দোটানার মধ্যে এক শুভানুধ্যায়ীর পরামর্শে ম্যানেজমেন্ট পড়ারই সিদ্ধান্ত নেন।
প্রিয়শঙ্করের কথায়, “সিদ্ধান্তটা কঠিন ছিল। অভাবের সংসার। বুঝেছিলাম, ম্যানেজমেন্ট পড়ার খরচ মেটাতে গেলে এমন ভাবে পড়তে হবে, যাতে সফল হয়ে চাকরি মেলে। কপাল ঠুকে প্র্যাক্সিস বিজ়নেস স্কুলে ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা (পিজিডিএম) করতে ভর্তি হয়ে যাই।” কিন্তু করোনাকালে অনলাইনে সেই পড়াশোনা করতে প্রিয়শঙ্করকে পড়তে হয়েছিল প্রবল সমস্যার মুখে।
বুধবার ফোনে ঘাটাল থেকে প্রিয়শঙ্কর জানান, ২০২০ সালে তিনি যখন ম্যানেজমেন্ট পড়তে ভর্তি হন, করোনা তখন থাবা বসিয়েছে সারা দেশে। তাই কলকাতায় এসে, হস্টেলে থেকে ক্যাম্পাসে ক্লাস করার প্রশ্ন ছিল না। ছিল না হস্টেলে থেকে পড়ার সঙ্গতিও। একমাত্র পথ, বাড়ি থেকে অনলাইনে ক্লাস করা। তাঁর পড়াশোনার আগ্রহ দেখে পরিচিত এক ব্যক্তি তাঁকে একটি ল্যাপটপ দেন।
প্রিয়শঙ্কর বলেন, “বাড়ি থেকে যে-ইন্টারনেট পরিষেবা পাওয়া যায়, তার গতি মর্মান্তিক।” ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ জয়ের এক অভাবনীয় লড়াই শুরু হয়। গ্রাম থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে খাসবাদে তুলনায় দ্রুত গতির ইন্টারনেট পরিষেবা রয়েছে, এমন এক সাইবার ক্যাফেতে বসে রোজ অনলাইন ক্লাস করতেন তিনি। সেই সঙ্গে যাঁরা ওই ক্যাফেতে অনলাইনে বিভিন্ন আবেদন করতে আসতেন, তাঁদের অনেকের কাজও করে দিতেন প্রিয়শঙ্কর। তিনি বললেন, ‘‘যে-দিন ভিডিয়ো চালু করে ক্লাস করার দরকার হত, সে-দিন ওই সাইবার ক্যাফেতে ক্লাস করা যেত না। যে-হেতু আরও কয়েকটি কম্পিউটার চলত, ভিডিয়ো অন করলে আমি আর স্যর-ম্যাডামদের দেখতে পেতাম না। তার জন্য চলে যেতে হত আরও কয়েক কিলোমিটার দূরের অন্য কোনও সাইবার ক্যাফেতে।” এ ভাবেই পড়াশোনা এবং সব পরীক্ষা দিয়েছেন। এমনকি, চাকরির অনলাইন ইন্টারভিউটাও এক বন্ধুর কোচিং সেন্টারে গিয়েই দিয়েছেন প্রিয়শঙ্কর।
এই ম্যানেজমেন্ট কোর্স শেষ হবে এপ্রিলে। তার পরে আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ংয়ে টেকনোলজি কনসালট্যান্ট পদে যোগ দেবেন ঘাটালের প্রিয়শঙ্কর। আশপাশের প্রায় সকলেই খেতে কৃষিকাজ বা ভিন্ রাজ্যে সোনার কাজ করেন। নেই অর্থের জোরও। শিক্ষা শিবিরের একাংশ জানাচ্ছেন, এমন পরিবেশে বড় হয়েও তুমুল ইচ্ছেশক্তি আর পরিশ্রমের অস্ত্রে যে-সাফল্য প্রিয়শঙ্কর অর্জন করেছেন, তা উদ্বুদ্ধ করবে ছাত্রসমাজকে।
প্রিয়শঙ্কর জানান, ইন্টারভিউয়ে সফল হতে প্র্যাক্সিস বিজনেস স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁকে অনেক সাহায্য করেছেন। ওই যুবক আরও জানিয়েছেন, তাঁর মতো অনটনের মধ্যে যাঁদের লেখাপড়া চালাতে হচ্ছে, চাকরিতে যোগ দিয়ে তিনি তাঁদের সাহায্য করতে চান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy