Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Jewellery Shop Robbery

সুবোধের তত্ত্বাবধানে শোন নদীর তীরে প্রশিক্ষণ দুষ্কৃতীদের! ডাকাতি বা খুনের আগে ছক কষাও হত

গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, গত বেশ কয়েকটি ডাকাতি, লুটপাটের ঘটনায় সুবোধ আর কুন্দন, দু’জনেরই যোগ রয়েছে। কিন্তু পটনার জেল থেকে এখনও সুবোধকে নিজেদের হেফাজতে পায়নি এ রাজ্যের পুলিশ।

কুন্দন যাদব (বাঁ দিকে)। রানাঘাটের স্বর্ণ বিপণিতে ডাকাতির সময় কুন্দন (চিহ্নিত)।

কুন্দন যাদব (বাঁ দিকে)। রানাঘাটের স্বর্ণ বিপণিতে ডাকাতির সময় কুন্দন (চিহ্নিত)। —ফাইল চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:০৬
Share: Save:

দু’জন লোক। দু’জনই বিহার থেকে এই রাজ্যে এসেছে দুষ্কর্ম করতে। এক জন এখন বিহারের জেলে। অন্য জন পশ্চিমবঙ্গের। কিন্তু বিহারে জেল থেকেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে প্রথম জন, ঘোরতর সন্দেহ পুলিশের।

প্রথম জন সুবোধ সিংহ। দ্বিতীয় জন কুন্দন যাদব।

গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, গত বেশ কয়েকটি ডাকাতি, লুটপাটের ঘটনায় সুবোধ আর কুন্দন, দু’জনেরই যোগ রয়েছে। কিন্তু পটনার জেল থেকে এখনও সুবোধকে নিজেদের হেফাজতে পায়নি এ রাজ্যের পুলিশ। তাই দু’জনকে সামনে বসিয়ে জেরা করার সুযোগও মেলেনি।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গিয়েছে, সুবোধের তত্ত্বাবধানে বিহারের বিভিন্ন জায়গায় রীতিমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হত দুষ্কৃতীদের। চলত কোনও বড় ডাকাতি বা খুনজখমের আগে ছক কষাও। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কী ভাবে ‘রেকি’ করা হবে জায়গাটি, তার প্রশিক্ষণ।

এখানেই এসে পড়ে নদিয়ার কল্যাণীর দু’টি ছোট ঘরের কথা। ছোট দু’টি খুপরি ঘর। তার একটিতে পাখা এবং খাটিয়া রয়েছে। অন্য ঘরে শুধু মাদুর পাতা। দমবন্ধকর পরিবেশ। জুলাইয়ের গোড়ায় এই ঘরগুলিই ভাড়া নিয়েছিল উনিশ থেকে ২৫ বছরের কয়েক জন যুবক। সেখান থেকে নিয়মিত রানাঘাটে যাতায়াত করত। ২৯ অগস্ট সেখানকার যে স্বর্ণ বিপণিতে ডাকাতি হয়, একাধিক বার সেখানে গিয়েও ‘রেকি’ করে এসেছিল তারা। যথেষ্ট আটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছিল বিহারের ওই যুবকেরা, তদন্তে নেমে টের পায় পুলিশ।

এই দুষ্কর্মের মধ্যমণি ছিল বিহারের বৈশালী জেলার মথুরাচকের কুন্দন যাদব। গোয়েন্দাদের সন্দেহ, তারও হয়তো প্রশিক্ষণ হয়েছিল বিহারে শোন নদীর বিস্তীর্ণ ফাঁকা এলাকায়। সেখানে হোগলার ঘর বানিয়ে তাতে থাকতে দেওয়া হয় দুষ্কৃতীদের। এটাও প্রশিক্ষণের অঙ্গ। গোয়েন্দাদের দাবি, মাস দেড়েক ধরে সুবোধের নির্দেশে পাপ্পু ওরফে রবি চৌধুরীর নেতৃত্বে চলে হাতেকলমে চলে ওই প্রশিক্ষণ।

কী সেখানো হয় সেখানে? কয়েকটি বিষয়কে তুলে ধরেছেন গোয়েন্দারা। যেমন, এক) কী ভাবে মোবাইলের সিম ব্যবহার করবে? দুই) কতটা কষ্ট করে থাকতে হবে রেকি করার সময়ে, যাতে কারও ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ না হয়? তিন) মোটরবাইকের ব্যবহারই বা কী ভাবে করা হবে?

রানাঘাট ও পুরুলিয়ার সোনার দোকানে ডাকাতির তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন: এক) কল্যাণীতে দমবন্ধকর পরিবেশে দু’টি ঘর ভাড়া নিয়েছিল কুন্দনরা মূলত রেকি করার জন্য। দুই) এ রাজ্যে ঢোকার আগে নতুন মোবাইল এবং নতুন সিম কিনেছিল দুষ্কৃতীরা। ঘটনার মাস কয়েক আগে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় থেকেই তারা ওই ফোন নম্বর ব্যবহার করতে শুরু করে। ডাকাতির পরে পুলিশ যাতে খোঁজ না পায়, তাই ওই মোবাইল আর সিম কার্ড তারা ফেলে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু দু’জায়গাতেই তা করতে পারেনি দুষ্কৃতীরা। সিমের সূত্র ধরেই পুলিশ তাদের খুঁজে পায়। তিন) ডাকাতির সময়ে যে মোটরবাইক দুষ্কৃতীরা ব্যবহার করে, তা হয় চোরাই নয়তো সেকেন্ড হ্যান্ডে কিনে ভুয়ো নম্বর প্লেট লাগানো। কাজ সেরে সেই বাইক ফেলে দিয়ে পালাচ্ছে দুষ্কৃতীরা।

গোয়েন্দারা বলছেন, পটনার জেলে বসেই সুবোধ সিংহ এই চক্র চালাচ্ছে। যা সাইবার অপরাধী জামতাড়া গ্যাংয়ের থেকে কোনও অংশে কম নয়। শোন নদীর তীরে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেখানে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোও শেখানো হয় বলে দাবি তাঁদের। ধৃতদের জেরা করেই এই সব তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। জানা গিয়েছে, প্রায় একশো ষাট জনকে এ ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে রানাঘাট, পুরুলিয়ার ডাকাতিতে যুক্ত দুষ্কৃতীরাও রয়েছে। এখানকার প্রশিক্ষিত দুষ্কৃতী সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে বলে দাবি তদন্তকারীদের।

পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ বিভাগ বলছে, কতটা পরিকল্পনামাফিক কাজ করে এই গ্যাং, তা সব থেকে ভাল বোঝা গিয়েছে রাজু ঝা হত্যাকাণ্ডে আততায়ীদের পালানোর ধরন থেকে। একই ভাবে রায়গঞ্জে গয়নার শো-রুমে এবং বীরভূমের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ডাকাতির পরেও অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গায়েব হয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা। দু’টি ঘটনাতেই এখনও ঘটনার কিনারা হয়নি। আবার, পুরুলিয়ায় স্বর্ণ বিপণিতে ডাকাতির ক্ষেত্রে দুষ্কৃতীরা ডেরা বেঁধেছিল প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে, ধানবাদের এক হোটেলে। সেখান থেকে এসেই রেকি করে যায়।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, কুন্দন ওই গ্যাংয়ে ‘ফাইটার’ নামে পরিচিত। বৈশালীর মথুরাচকের এই যুবককে প্রথম দেখা যায় রাজু ঝা খুনে সিসিটিভি ফুটেজে। সেখানে গাড়িতে বসে থাকা রাজুকে সামনে থেকে গুলি করে চলে যাওয়ার সময়ে হলুদ জামা পরা এক যুবকের হাত থেকে পিস্তল পড়ে যায়। পুলিশের দাবি, সে-ই কুন্দন। রাজু খুনে কুন্দনের ভাই মুকেশ যাদবকে আগেই গ্রেফতার করে পুলিশ।

বৈশালীর বিধোপুর থানা সূত্রের খবর, বেশ কয়েক মাস আগে সেখানেও কুন্দনের বিরুদ্ধে লুটপাট ও খুনের চেষ্টার মামলা হয়েছিল। তার পর থেকে সে এলাকাছাড়া ছিল। এক-একটা বড় ‘অ্যাকশন’ করে টাকাকড়ি নিয়ে কিছু দিন গা-ঢাকা দিত কুন্দনের দলবল। টাকা ফুরিয়ে এলে ফের নতুন অপরাধের ছক কষত। রায়গঞ্জে গয়নার দোকানে বড় ডাকাতির সঙ্গে তারাই জড়িত বলে পুলিশের সন্দেহ।

কুন্দনের মতোই পুলিশকে নাজেহাল করার ইতিহাস আছে সুবোধেরও। গত কয়েক বছরে এ রাজ্যের একাধিক জায়গায় স্বর্ণ ঋণদান সংস্থায় লুটপাটে অভিযুক্ত সে ও তার দলবল। ব্যারাকপুরের বিজেপি নেতা মণীশ শুক্ল খুনেও নাম রয়েছে তার।

১৫ সেপ্টেম্বর নদিয়ার চাপড়ার বাদলাঙ্গি মোড় থেকে ‘কুখ্যাত’ দুষ্কৃতী মাসুদ মণ্ডল ওরফে ‘হাত-কাটা মাসুদ’ ও তার দলবলকে অস্ত্রশস্ত্র-সহ গ্রেফতার করে পুলিশ। মাসুদকে জেরা করে বাদলাঙ্গির একটি নির্মীয়মাণ দোকান বোমার হদিস মেলে। গোটা দশেক খুন-ডাকাতির মামলায় অভিযুক্ত মাসুদ ও তার সঙ্গীরা। নদিয়া ছাড়াও বর্ধমান, হুগলি বা মুর্শিদাবাদ জেলাতেও নানা দুষ্কর্মে তাদের হাত কতটা, দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

এই সব দুষ্কৃতী-দল একের সঙ্গে অন্যে যুক্ত কি না, তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ। এ ছাড়াও, রয়েছে কাটিহার গ্যাং। লুটপাট, ডাকাতি-সহ নানা অপরাধে দড় এই দলটিও।

কিন্তু এই সব সশস্ত্র দুষ্কৃতী এত অনায়াসে কী ভাবে এ রাজ্যে ঢুকে পড়ে? ‘অপারেশন’ সেরে পুলিশের নজর এড়িয়ে সীমানাই বা পেরোয় কী ভাবে?

অন্য বিষয়গুলি:

Ranaghat Bihar Jamtara Gang
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy