Advertisement
১৬ অগস্ট ২০২৪
Bandhan bank CEO

সাফল্যের শিখর ছুঁয়েছেন চন্দ্রশেখর, বাংলাও আবদ্ধ তাঁর বন্ধনে, স্বেচ্ছাবসরে ব্যতিক্রমী বাঙালি ব্যবসায়ী

স্বাধীনোত্তর কালে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধন ব্যাঙ্ক। এ পর্যন্ত সম্ভবত শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী চন্দ্রশেখর ঘোষ। তিনি স্বেচ্ছাবসরে যাচ্ছেন। তবে বাঙালি কোনও দিনই ভুলতে পারবে না এই ব্যতিক্রমী বাঙালির অবদান।

How Chandra Shekhar Ghosh made his Bandhan bank successful

বন্ধন ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও চন্দ্রশেখর ঘোষ। —ফাইল চিত্র।

পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২৪ ০৮:৫৯
Share: Save:

প্রতিযোগিতা কঠিন ছিল। নতুন ব্যাঙ্ক গড়ার জন্য ২০১৩ সালে ২৭টি আবেদন জমা পড়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে। তবে পরে সেটা প্রত্যাহার করে নেয় টাটা সন্স এবং ভিডিয়োকন গ্রুপ। তার পরেও ব্যাঙ্ক গড়ার লাইসেন্স পাওয়ার প্রতিযোগিতায় ছিল অনিল অম্বানী গ্রুপ, আদিত্য বিড়লা গ্রুপ, বাজাজ ফিনান্সের মতো বড় বড় সংস্থা। জিতেছিল দু’টি সংস্থা। তার মধ্যে একটি স্বাধীন ভারতের অন্যতম ‘সেরা বাঙালি’ চন্দ্রশেখর ঘোষের ‘বন্ধন’। মাত্র ন’বছরে সংস্থাকে নজিরবিহীন সাফল্যের পথ দেখিয়ে মঙ্গলবার স্বেচ্ছাবসরে যাচ্ছেন সংস্থার এমডি এবং সিইও চন্দ্রশেখর। তবে মিতবাক মানুষটি নিজের সিদ্ধান্ত বা সাফল্য নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নন।

বাঙালি বড় গায়ক হয়েছে। বড় কবি হয়েছে। গত ১৫ বছরের মধ্যে দুই বাঙালি নোবেল পেয়েছেন। অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আন্তর্জাতিক স্তরের খ্যাতনামী বাঙালি । রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য তো বটেই, জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব তৈরি করেছেন। ক্রিকেটে বাঙালির ধ্বজা উড়িয়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু জাতীয় স্তরে সফল বাঙালি ব্যবসায়ী খুব একটা দেখা যায়নি। চন্দ্রশেখর সে দিক দিয়েও দৃষ্টান্ত।

দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে চন্দ্রশেখর ঘোষ।

দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি এবং রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে চন্দ্রশেখর ঘোষ। —ফাইল ছবি

ব্যবসার ক্ষেত্রে চন্দ্রশেখরের বন্ধন ব্যাঙ্কের সাফল্য বাঙালির কাছে শিক্ষণীয়ও বটে। কারণ, এটি নিছক একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নয়। বাংলায় বাঙালির দ্বারা একটি সফল প্রতিষ্ঠান যে তৈরি হতে পারে, এগিয়ে যেতে পারে, চন্দ্রশেখর তা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছেন। ত্রিপুরার আগরতলায় বাবার মিষ্টির দোকানে কাজ করা, বাংলাদেশে চাকরি করা, সেই চাকরি ছেড়ে স্ত্রী নীলিমা ঘোষকে সঙ্গী করে কোনও আস্ফালন বা রাজানুগত্য না দেখিয়ে কঠোর পরিশ্রমের পথে হেঁটে সাফল্য এনেছেন চন্দ্রশেখর। ব্যবসার ক্ষেত্রে এমন বাঙালি দুর্লভ। সন্দেহ নেই যে, তিনি এক ‘ব্যতিক্রমী’ বঙ্গসন্তান। যিনি স্বেচ্ছাবসরের ইস্তফাপত্রের শেষে লিখেছিলেন, ‘‘আমি গর্বিত যে, পরবর্তী নেতৃত্বের জন্য একটি মজবুত সংস্থাকে ছেড়ে যাচ্ছি।’’ তবে অবসর নিলেও তিনি বন্ধনের বন্ধনেই থাকবেন বলে জানিয়ে রেখেছেন। ন’বছর আগে যে সংস্থার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল, এখন তা প্রায় মহীরুহ।

বস্তুত, ব্যাঙ্কিং পরিষেবার ব্যবসার ক্ষেত্রের পাশাপাশি চন্দ্রশেখর তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রেও। সল্টলেকে হাসপাতাল খুলেছেন। কিনেছেন কলকাতা শহরের অন্যতম প্যাথোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি। ভবিষ্যতের জন্য যা যথেষ্ট অর্থবহ ইঙ্গিত।

২০১৫ সালের ২৩ অগস্ট বাঙালির জীবনে বিরল গর্বের দিন। বাংলায় কোনও ইতিবাচক সম্ভাবনার অঙ্কুর দেখা যায় না বলে আক্ষেপ লাঘব হয়েছিল সেই দিনটিতে। ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘বন্ধ্যা’ জমিতেই বন্ধন ব্যাঙ্কের জন্ম হয়েছিল। তখন চন্দ্রশেখর এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তিনি এমন অনেক ব্যাঙ্কের তরফে শুভেচ্ছাবার্তা পেয়েছেন, যারা তাঁর লড়াইয়ের সময়ে তাঁকে অ্যাকাউন্ট খুলতেও দেয়নি। অথচ চন্দ্রশেখরের বন্ধন ব্যাঙ্ক শুধু বাংলার নয়, পূর্ব ভারতের প্রথম বেসরকারি ব্যাঙ্ক। বন্ধনই প্রথম কোনও নন ব্যাঙ্কিং আর্থিক সংস্থা (এনবিএফসি), যা ব্যাঙ্কে উন্নীত হয়।

বন্ধন ব্যাঙ্কের অনুষ্ঠানে প্রণব মুখোপাধ্যায়। রয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীও।

বন্ধন ব্যাঙ্কের অনুষ্ঠানে প্রণব মুখোপাধ্যায়। রয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীও। —ফাইল ছবি

শুরু থেকেই সংস্থার হাল ধরে রয়েছেন চন্দ্রশেখর। মঙ্গলবার তাঁর কর্মজীবনের ইতি। নিজেই স্বেচ্ছাবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ৬৩ বছরের চন্দ্রশেখর। তবে বন্ধনের বন্ধনেই থাকছেন। ইস্তফাপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘‘প্রায় এক দশক ব্যাঙ্কের এমডি এবং সিইও হিসাবে দায়িত্ব পালন করার পর এখন মনে হচ্ছে, আরও বৃহত্তর দায়িত্ব নেওয়ার সময় এসেছে। বন্ধন গোষ্ঠীর নীতি ও কৌশল নির্ধারণকারীর ভূমিকায় কাজ করার সময় এসেছে। তাই ৯ জুলাই, ২০২৪ আমার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’

অনেকটা রাস্তা এগিয়ে যাওয়ার পরেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চন্দ্রশেখর। মাত্র তিন জন কর্মী নিয়ে শুরু তাঁর উদ্যোগে এখন কর্মীর সংখ্যা ৭৫ হাজারের বেশি। গ্রাহক সংখ্যা ৩.৩৬ কোটি। জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বন্ধন ঋণ দিয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকা। গোটা দেশে শাখার সংখ্যা ৬,২৯৭। এটা ঠিকই যে, বন্ধন যে পথে হাঁটছে, তাতে আরও অনেক সাফল্যের মাইলফলক পার করার কথা। তবে বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, বন্ধনের মৌলিক স্বাস্থ্য এখনই ভারতের বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের তুলনায় এগিয়ে।

ব্যাঙ্কের স্বীকৃতি পাওয়ার আগে থেকেই চন্দ্রশেখরের নজরে ছিলেন সেই মানুষেরা, যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক লেনদেনের আওতার বাইরে থেকে গিয়েছিলেন। একটা সময়ে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার হিসাবে কর্মরত চন্দ্রশেখর ব্যবসাকে ব্যবসার চোখেই দেখেছেন। ‘সেবামূলক’ ক্ষেত্র বানাতে চাননি। তাই আর্থিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণির ব্যাঙ্ক হয়ে থাকেনি বন্ধন। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের ব্যাঙ্ক হয়ে উঠেছে গত প্রায় এক দশকে। চন্দ্রশেখর বুঝেছিলেন, শুধু নিম্নবিত্তের ব্যাঙ্ক হতে চাইলে নাম কামানো যেতে পারে। কিন্তু ব্যবসায় সাফল্য মেলে না। কারণ, ব্যাঙ্কে অর্থের যথেষ্ট জোগান থাকা প্রয়োজন। আর নিম্নবিত্তের টাকা জমা করার ক্ষমতা সামান্য। সেই টাকা নিয়ে ব্যাঙ্ক চালাতে গেলে লাভের চেয়ে পরিচালন ব্যয় বেশি হয়ে যায়। আমানতের গড় পরিমাণ বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে শুরুর পর থেকেই অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ দিতে আরম্ভ করে বন্ধন।

ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে বাংলার অতীত গর্বের জায়গা ছিল। ব্রিটিশ জমানায় ১৭৭০ সালে ব্যাঙ্ক অফ হিন্দুস্থানের জন্ম হয়েছিল। পরে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এই বাংলাতেই জন্ম রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার। পরে ১৯৩৭ সালে সদর দফতর মুম্বইয়ে চলে যায়। দেশের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া তো শুরুই হয়েছিল ‘ব্যাঙ্ক অফ কলকাতা’ নামে। পরে নাম হয়েছিল ‘ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল’। কালক্রমে সেই ব্যাঙ্কও মুম্বইকেন্দ্রিক। ভারতে অর্থনৈতিক উদারীকরণ শুরু হওয়ার পরে ১৯৯৩ সালে অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সময়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নতুন করে বেসরকারি ব্যাঙ্কের অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পর অনেক ব্যাঙ্কের জন্ম হলেও বেশির ভাগই টিকে নেই। অনেকগুলিই মিশে গিয়েছে অন্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে। ২০১০ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় আবার বেসরকারি ব্যঙ্কের দরজা খুলে দেন। সেই উদ্যোগের ফলেই ২০১৩ সালে আবেদন নিতে শুরু করে আরবিআই। যার ফলে বন্ধন ব্যাঙ্কের জন্ম। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও প্রণব বন্ধনের প্রথম বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘‘বন্ধন ব্যাঙ্কের মতো প্রতিষ্ঠান আধুনিক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এটা শুধু ধনী নয়, সেই শ্রেণিকেও উপকৃত করবে, যাঁরা উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখেন।’’ কংগ্রেসের প্রণবই শুধু নন, বিজেপি সরকারের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও উদ্বোধনের দিনে বলেছিলেন, ‘‘একটি মহৎ প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে বাংলায়। বন্ধন ব্যাঙ্কের সূচনা শুধু বাংলার শিল্পের উন্নতিতেই কাজ করবে তা নয়, বাংলায় শিল্প ফিরিয়ে আনার কাজও করবে।’’ আর বাংলার তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেছিলেন, ‘‘বন্ধন নারী সশক্তিকরণ এবং দারিদ্র দূরীকরণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। সেই লক্ষ্যে এই প্রতিষ্ঠান সফল।’’

বন্ধন ব্যাঙ্ক থেকে স্বেচ্ছাবসর নিলেও বন্ধন পরিবারের সঙ্গে চন্দ্রশেখরের সম্পর্ক যে ছিন্ন হচ্ছে না, তা অনুমান করা কঠিন নয়। তিনি রতন টাটার মতো ‘এমেরিটাস’ হয়ে থাকবেন? মিতবাক মানুষটি এই প্রশ্নেও নীরবই থেকেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Chandra Shekhar Ghosh Bandhan Bank
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE