মিসকিন মন্ডল। নিজস্ব চিত্র
করোনা-পরিস্থিতির মধ্যে হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছিল স্বামীর। চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া ছেলের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারবেন না বুঝে সাবিত্রী সরেন তাকে কাজে পাঠিয়েছিলেন অন্যের খামারে। বাধা হয়ে দাঁড়ান এলাকার এক শিক্ষক। ছেলেটির বাড়ি গিয়ে বই-খাতা, জুতো, জামা-প্যান্ট কিনে দেন। পড়াশোনায় ফিরেছে ছেলেটি।
মামার বাড়িতে বেড়ে ওঠা এক বালিকার পড়াশোনা নানা অসুবিধায় চালাতে পারছিলেন না পরিজন। সে বাড়িতেও পৌঁছে যান ওই শিক্ষক। বইপত্র, পোশাক কিনে দেন। মেয়েটির অভিভাবক সিদে সরেন বলেন, ‘‘করোনার সময়ে সংসারে টানাটানিতে অসুবিধা হচ্ছিল। মাস্টারমশাই ব্যবস্থা করেছেন। পড়ার খরচ নিয়ে অসুবিধা হলে জানাতে বলেছেন।’’
পূর্ব বর্ধমানের ভাতারের মেনাডাঙা গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বছর পঁচিশের মিসকিন মণ্ডল করোনা-কালে প্রত্যন্ত এলাকার অনেক পড়ুয়াকে এ ভাবেই বনস্পতির ছায়া দিচ্ছেন। মিসকিন স্কুলে যোগ দেন প্রাণিবিদ্যায় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ২০১৭ সালে। স্কুল থেকে কিছুটা দূরে ঝুঝকাডাঙা গ্রামের বাসিন্দা এই যুবক বছরখানেক ধরে নিজের উদ্যোগে চালু করেছেন ‘অনলাইন’ ক্লাস। ‘হোয়াটসঅ্যাপ’-এ গ্রুপ তৈরি করে পড়ুয়াদের প্রশ্নপত্র দিচ্ছেন। দু’সপ্তাহ অন্তর মেনাডাঙা গ্রামে গিয়ে পড়ুয়াদের উত্তরপত্র পরীক্ষা করছেন। শুধু পড়ানো নয়, প্রত্যেক পড়ুয়াকে নির্দিষ্ট সময় অন্তর খাতা, কলম-সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়েও সাহায্য করেছেন। লকডাউনের সময়ে বাড়ি-বাড়ি খাদ্যসামগ্রীও পৌঁছে দিয়েছেন তিনি।
স্কুল সূত্রে জানা যায়, ওই এলাকায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ১২৫ জন পড়ুয়া রয়েছে। সবার কাছে ‘স্মার্ট ফোন’ নেই। মিসকিন বলেন, ‘‘ওই গ্রামে আমার প্রাক্তন ছাত্র রয়েছে ছ’জন। তাদের স্মার্ট ফোনের সাহায্য নেওয়া হয় অনলাইন ক্লাসের জন্য। সপ্তাহে দু’দিন করে এক-একটি ক্লাসের পড়ুয়াদের নিয়ে ক্লাস করানো হয়।’’ তাঁর দাবি, ‘ভিডিয়ো কল’-এ ক্লাস করতে খুদেদের উৎসাহ রয়েছে। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র দেবু টুডুর কথায়, ‘‘স্যরের কথা মতো আমরা ছাত্রছাত্রীদের ডেকে আনি। ক্লাস শেষে তাদের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। আমাদেরও ভাল লাগে।’’
ওই শিক্ষকের দাবি, এলাকার বেশিরভাগই প্রান্তিক মানুষ। করোনা-পরিস্থিতিতে পরিবারগুলির পক্ষে দু’মুঠো খাবার জোগাড় করা কষ্টসাধ্য। সেখানে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানো অনেকের পক্ষেই সমস্যার। তাই অনেক পরিবার ছেলেমেয়েকে কাজে পাঠানো শুরু করেছিল। তখন কী ভাবে ওই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় ফেরাবেন, সে ভাবনার শুরু। শিক্ষকের কথায়, ‘‘ওই পাড়ার কয়েক জন ছাত্র ‘অনলাইন গেম’ খেলার জন্য স্মার্ট ফোন কিনেছে। তাদের বুঝিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গ্রুপ খোলা হয়। ওদের বলি, বাড়ির ভাইবোনদের অনলাইনে ক্লাস নেব। ধীরে ধীরে এলাকার পড়ুয়ারাও জুটে যায়।’’
স্থানীয় বাসিন্দা জিতেন হাঁসদার দাবি, ‘‘স্কুল খোলা না থাকায় অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ওই শিক্ষকের এই উদ্যোগ খুবই কাজে দিচ্ছে।’’ চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রের মা সাবিত্রী সরেন বলেন, “ওঁর (মিসকিন) কথা অমান্য করবে, এলাকায় এমন কেউ নেই।’’ ভাতার পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ জয়ন্ত হাটির মন্তব্য, ‘‘শিক্ষকেরা এ ভাবে যত এগিয়ে আসবেন, প্রান্তিক মানুষজন আলোর দিশা পাবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy