প্রদীপ জ্বালিয়ে আর জি করের নির্যাতিতাকে স্মরণ জুনিয়র ডাক্তারদের। বাজে কদমতলা ঘাটে। বুধবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
রাত ৩টে। শুনশান রাস্তার মোড়ে দুই পুলিশকর্মী। চেয়ারে গা এলিয়ে মোবাইলে চোখ। কিছুটা দূরেই বাতিস্তম্ভের নীচে কয়েকটি পথ কুকুর। আঁকাবাঁকা পথে সেই বাড়ি।
দরজায় চিকিৎসক-পড়ুয়ার নামের বোর্ডের উপরে সাদা আলো জ্বলছে। বাকি বাড়ি অন্ধকার। রাতভর পাহারায় থাকা দুই পুলিশকর্মীর এক জন বললেন, “গেটের এই আলোটা সারা রাত জ্বলে। মাসিমা (মৃতার মা) এক দিন বলছিলেন, ‘আমার মেয়ের নামটাই তো মুছে যাচ্ছে, সবাই ওকে এখন তিলোত্তমা, অভয়া বলে ডাকছে। অন্তত বাড়িতে ওর নামের বোর্ডটার উপরে আলো থাক!’”
ভোর ৪টে। রাস্তায় কয়েক জন হাঁটতে বেরিয়েছেন সবে। আলো জ্বলতে শুরু করল আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ— মহিষাসুরমর্দিনী। শুধু বাড়িটার বদল হল না। অন্ধকার। এক পুলিশকর্মী বললেন, “ওঁরা বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোন না। মিছিলে যোগ দিতে যাবেন বলে গত কাল বিকেলে বেরিয়েছিলেন। রাত ১১টায় ফেরেন। আজ মহালয়া। হয়তো আরওই বেরোবেন না!”
ভোর ৬টা। বৃষ্টি। কোনও মতে শাটার টানা একটি দোকানের সামনে মাথা গুঁজে দুই পুলিশকর্মী বললেন, “রোজ ৭টার একটু আগে মাসিমা বেরোন। নিজেই বাড়ির সামনে ঝাঁট দেন। অত্যন্ত সাধারণ মানুষ। মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে, ঝাঁট দিতে দিতে চোখ থেকে জল পড়ছে। এর পরে ভিতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। আমাদের সাহস হয় না কথা বলার।”
এই কথাবার্তার মধ্যেই সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ বেরিয়ে এলেন তিনি। বাড়ির সামনেটা পরিষ্কার করছিলেন। মুখোমুখি হতেই বললেন, “কাল অনেক রাতে ফিরেছি, ভাল লাগছে না।” কোনও মতে বলা হল, আজ তো মহালয়া! কথাটা শুনেই হাতের সব কিছু মাটিতে রেখে মাঝবয়সি মহিলা আঁচল টেনে নিলেন চোখের কাছে। বললেন, “যত ব্যস্ততাই থাক, এই দিনটায় আমার মেয়ে রেডিয়ো শুনবেই। সেই রেডিয়ো আজ পড়েই রইল। সে-দিনের পর থেকে রাতে তো দু’চোখের পাতা এক করতে পারি না। আজ সকালেও আমি আর ওর বাবা কোনও রকমে বিছানায় পড়ে ছিলাম। কথা বলার সাহসও হচ্ছিল না।”
চোখের জল মুছলেন তিনি। বললেন, “পাশের বাড়ির রেডিয়োর আওয়াজ ঘরে ঢুকছিল। শুনছি আর আমার মেয়েটার মুখ মনে পড়ছে। কোনও মতে উঠে জানলাটা ঠেসে বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। এর পর নিজেকে শুধু বলে গিয়েছি, আমার মেয়ের চিন্তা তো আর আমাদের একার নয়। এত মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। এ বার বিচার হবেই। শুধু ও কিছুই জানতে পারবে না।”
এই কথাবার্তার মধ্যেই বেরিয়ে এলেন বাবা। বললেন, “মহালয়া বলে আমাদের আর আলাদা কিছু নেই। যে দিন আমরা বিচার পাব, সেই দিনই আমাদের মহালয়া, সেই দিনই আমাদের পুজো।” বেরিয়ে আসার পথে চোখে পড়ল, বিচার চেয়ে লাগানো পোস্টার, ব্যানার। রাস্তা জুড়ে লাউডস্পিকারে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
এ এক অন্য ভোর। বিচারের আশায় যে ভোরের দখল নেওয়ার ডাক দিয়ে পথে নেমেছে শহর। যে ভোরের আলো ফোটার আগে পর্যন্ত অন্ধকারেই ডুবে থাকে এক তরুণী-চিকিৎসকের বাড়ি।
নামের বোর্ডের উপর আলো কি তখনও জ্বলছিল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy