মৃত পুরোহিত সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়(ইনসেটে)। শোকে ভেঙে পড়েছেন আত্মীয়েরা। ছবি: প্রণব দেবনাথ
নবমীর দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন শান্তিপুরের বাগআঁচড়ার বাগ্দেবী মন্দিরের সেবাইত সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় (৪২)। তিন দিন পরে, বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর দেহ ভেসে উঠল মন্দিরের পিছনে একটি জলাশয়ে।
সুপ্রিয়র মৃতদেহ মেলার পরেই উত্তেজনা ছড়ায় এলাকায়। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে দীর্ঘক্ষণ দেহ আটকে রেখে বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসী। পরে পুলিশ তিন জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। সুপ্রিয় তাঁদের কর্মী ছিলেন বলে বিজেপি সাংসদ এসে দাবি করলেও স্থানীয় সূত্রে তার সমর্থন মেলেনি।
বাগ্দেবীতলারই বাসিন্দা ছিলেন সুপ্রিয়। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, পারিবারিক অশান্তির জেরে বছর ছয় আগে তাঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করেন। বাড়িতে রয়েছেন তাঁর বৃদ্ধা মা সুষমা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দুই মেয়ে— বাগআঁচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী শ্যামশ্রী ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তনুশ্রী।
সুষমার অভিযোগ, তাঁর ছেলেকে খুন করা হয়েছে। তাঁর দাবি, “ছেলের কাছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ছিল। সেই কারণেও কেউ ওকে খুন করতে পারে।’’ তিনি জানান, বাড়িতে আগে এক বার চুরি হওয়ায় ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুললে সুপ্রিয় তা তিনি নিজের কাছেই রাখতেন। ষষ্ঠীর দিন, শুক্রবার তিনি পুজোর এবং অন্য খরচের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় ৬০ হাজার টাকা তোলেন বলে তাঁর মায়ের দাবি। তবে পরিবার সূত্রেই খবর, সুপ্রিয় মদ্যপান করতেন। বলে তার পরিবার সুত্রে জানা গেছে। নবমীর রাতে বেরিয়েও তিনি মদ্যপান করেছিলেন বলে প্রাথমিক ভাবে পুলিশের ধারণা।
পরিবার এবং স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পুজোর সময়ে পৌরোহিত্যের কাজের ফাঁকে দুই মেয়েকে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন সুপ্রিয়। তবে সোমবার, নবমীর রাতে তিনি একাই স্কুটার নিয়ে বেরিয়েছিলেন। বাগ্দেবীতলা থেকে কিলোমিটার দুই দূরে পাশের গ্রাম লক্ষ্মীনাথপুরে যান। সেখানে জিএসএফপি প্রাথমিক স্কুলের সামনের মাঠে পুজো হচ্ছিল। মেলাও বসেছিল। এর পরে আর তিনি বাড়ি ফেরেননি।
সুপ্রিয়র এক ভাইপো রণব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, কাকা বাড়ি না ফেরায় তাঁরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। লক্ষ্মীনাথপুরের মেলাতেও যান। তাঁর দাবি, ‘‘সেখানে কয়েক জন আমাদের বলে, তারা কাকাকে তাঁর স্কুটারেই চাপিয়ে রাতে বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। পরে তারা কাকার স্কুটার নিয়েই ফিরে যায়। আমাদের তারা সেই স্কুটার নিয়ে যেতে বলে। আমরা আনিনি।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, পুজোর জন্য ওই স্কুলের কয়েকটি ঘর ব্যবহার করা হচ্ছিল। সেখানে দু’টি ঘরে তালা দেওয়া ছিল। সেগুলি খুলে দেখতে চাইলেও তা দেখানো হয়নি। পরে পরিবারের তরফে শান্তিপুর থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়। সুপ্রিয় ওরফে ভোম্বল এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন। কারও সঙ্গে তাঁর শত্রুতা ছিল বলেও কেউ শোনেননি। এ দিন সকালে বাগ্দেবীপুরে বিক্ষোভ শুরু হয়। পুলিশ গেলে তাদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। ভালুকা যাওয়ার রাস্তা অবরোধ করেন গ্রামবাসী।
এরই মধ্যে সকাল ৮টা নাগাদ বাগ্দেবী মন্দিরের পিছনের একটি জলাশয়ে সুপ্রিয়র দেহ ভাসতে দেখেন এলাকার কিছু বাসিন্দা। পুলিশ দেহ তুলতে গেলে বাধা দেওয়া হয়। গ্রামের কিছু লোকজন দাবি করেন, সিআইডি আনতে হবে। রণব্রতের অভিযোগ, “আমরা লক্ষ্মীনাথপুরে গিয়ে কাকার খোঁজে কয়েক জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। পরে পুলিশ বলে, আমরা সেখানে গিয়ে গণ্ডগোল করেছি। উল্টে আমাদেরই হুমকি দেয় পুলিশ।”
উত্তেজনা ছড়ালে ঘটনাস্থলে যান এসডিপিও (রানাঘাট) লাল্টু হালদার, শান্তিপুর সার্কেল ইনস্পেক্টর জয়ন্ত লোধচৌধুরী-সহ পদস্থ পুলিশ কর্তারা। দুপুরে হাজির হন রানাঘাটের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার। তিনি বলেন, “ভোটের আগে এই মন্দিরে আমি পুজো দিয়েছি। উনি আমায় আশীর্বাদ করেছিলেন।’’ এর পরেই তাঁর দাবি, ‘‘সুপ্রিয় আমাদের দলের কর্মী ছিলেন। এর পিছনে শাসক দলের লোকেরাই আছে। পুলিশ সব ধামাচাপা দিতে চাইছে।” সকলের সামনেই পুলিশকে ভর্ৎসনাও করতে থাকেন তিনি। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে চাপের মুখে এসডিপিও-কে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হয়।
রণব্রত অবশ্য বলেন, “কাকা সক্রিয় ভাবে কোনও রাজনৈতিক দল করতেন না। ভোটের আগে পুজো দিতে জগন্নাথবাবু মন্দিরে এলে তাঁকে আশীর্বাদ করেছিলেন, ওই পর্যন্তই।” তৃণমূলের রানাঘাট সাংগঠনিক জেলা সভাপতি শঙ্কর সিংহ বলেন, “আমরাও পুলিশকে বলব, যেন দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। তবে এর মধ্যে কোনও রাজনীতি নেই।”
এই সব তর্ক-বিতর্কে বেলা গড়িয়ে দুপুর ১টারও পরে জলাশয় থেকে দেহ তোলা হয়। তত ক্ষণে দেহে পচন ধরতে শুরু করেছে। বাইরে থেকে আঘাতের চিহ্ন বোঝা না গেলেও সুপ্রিয়র ডান হাতে একটি সাদা কাপড়-জাতীয় জিনিস ধরা ছিল। বাঁ হাতে জ্বলজ্বল করছে উল্কি, যাতে লেখা ‘বাগদেবী’।
পরে লক্ষ্মীনাথপুরের স্কুলে গিয়ে এসডিপিও ঘরগুলি ঘুরে দেখেন। তালাবন্ধ যে দু’টি ঘরের একটির চাবি আনিয়ে তিনি ভিতরে যান। সেখানেই রাখা ছিল সুপ্রিয়র স্কুটার। ঘরের মেঝেও খুঁটিয়ে দেখেন তিনি। জলের ফোঁটা ফেলে তাতে সাদা কাগজ ঘষে দেখেন। সেই ঘরে পুজোর মাইক ও বক্স বাজানোর সরঞ্জাম রাখা ছিল। সেই সব বাক্স সরিয়েও দেখেন তিনি। মেঝেতে সিগারেটের টুকরো, খালি প্যাকেট পড়ে ছিল। তবে অন্য একটি ঘরের চাবি পাওয়া যায়নি।
লক্ষ্মীনাথপুরের বাসিন্দা তথা শান্তিপুর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ রমা সরকারের দাবি, “রাতে অসীম মণ্ডল নামে এলাকারই এক জন এসে আমার স্বামীকে ডেকে বলে, পুজোর ওখানে সুপ্রিয়র সঙ্গে ঝামেলা হচ্ছে। আমার স্বামী অন্য এক জনকে ডেকে বলেন ঝামেলা মিটিয়ে দিতে। এর পর কী হয়েছে জানি না। আমরা আর বেরোইনি।” অসীমের বাড়িতে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। অসীমের মা করুণা মণ্ডলের দাবি, “আমার ছেলে মেয়ে-বৌকে নিয়ে সামনের পুজোর মণ্ডপে গিয়েছিল। তার পর বাড়ি চলে আসে। সুপ্রিয়কে ও ‘মামা’ ডাকত। ঝামেলা দেখে পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যের বাড়িতে জানাতে গিয়েছিল। কোনও ঝামেলার মধ্যে ছিল না।”
কাঁদতে-কাঁদতে সুপ্রিয়র মা বলেন, ‘‘কয়েক বছর আগে ওদের মা চলে গেল। এখন বাবাকেও কেড়ে নিল। এই মেয়ে দুটোর কী হবে?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy