টানা বৃষ্টির কারণে বিপর্যস্ত দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা। — নিজস্ব চিত্র।
ঘূর্ণাবর্ত এবং মৌসুমি অক্ষরেখার প্রভাবে টানা বৃষ্টি চলছে দক্ষিণবঙ্গের বেশির ভাগ জেলায়। তার জেরে জল জমেছে বেশ কিছু জেলার বহু অংশে। কোথাও ভেঙে পড়েছে সেতু। কোথাও আবার সেতুর উপর দিয়ে বইছে জল, সেতু না কি নদী, বোঝার উপায় নেই। রাস্তাতেও অথৈ জল। তার জেরে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বহু গ্রাম যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্ধ অন্ডাল বিমানবন্দর। বাঁকুড়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। ভেঙে পড়েছে বহু কাঁচা বাড়ি। পূর্ব বর্ধমানের কিছু অংশে বহু মানুষ ঘর ছেড়ে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। কোনও কোনও জেলার কিছু অংশে সতর্কতা অবলম্বন করে কিছু জায়গায় বন্ধ রাখা হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। ফলে ভোগান্তি বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের। কেউ কেউ প্রশাসনের দিকে আঙুল তুলেছেন। হুগলির দাদপুরে জলমগ্ন রাস্তায় ধানগাছ রোপণ করে প্রতিবাদ জানিয়েছে বিরোধী বিজেপি।
বৃহস্পতিবার রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে জলবন্দি পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল শিল্পাঞ্চলের একাংশ। গাড়ুই ও নুনিয়া নদীতে উপচে পড়ছে জল। নদীর তীরবর্তী স্থানে ঘরবাড়িগুলিতে ঢুকে পড়েছে সেই জল। আসানসোলের দিলদারনগর, চেলিডাঙ্গা, রেলপাড়ের মুখশুদ্ধি মহল্লা, রামকৃষ্ণডাঙা, জাহাঙ্গির মহল্লা, বেলডাঙা, নিয়ামতপুরের প্রিয়া কলোনি, দোমোহানি, রানিগঞ্জ, জামুরিয়া এবং দুর্গাপুরের নিচু এলাকাগুলি জলমগ্ন। বেশ কিছু জায়গায় বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার জলে ডুবে গিয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে ওই সব এলাকায় বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে বিদ্যুৎ দফতর। পাশাপাশি, বাসিন্দাদের সতর্কও করা হয়েছে। বিদ্যুৎ দফতরের আঞ্চলিক ম্যানেজার বিশ্বজিৎ বাগদি সাধারণ মানুষকে বিদ্যুতের খুঁটি বা তারে হাত দিতে বারণ করেছেন। ভারী বৃষ্টির কারণে বন্ধ রয়েছে অন্ডাল বিমানবন্দর।
এই ‘জলযন্ত্রণা’র জন্য স্থানীয়েরা প্রশাসনের দিকেই আঙুল তুলেছেন। স্থানীয় বাসিন্দা লক্ষ্মণ সিংহ বলেন, ‘‘বার বার প্রশাসনকে নদী ড্রেজ়িং করার কথা জানালেও তারা পদক্ষেপ করেনি। নদীর পার দখল করে ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে।’’ এই নিয়ে সরব হয়েছেন বিজেপি নেতা জিতেন্দ্র তিওয়ারি। তাঁর কথায়, ‘‘প্রশাসন পাপ করছে। আসানসোলের রেলপাড়-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় যে সব বাড়িতে জল ঢুকে যাচ্ছে, সেখানকার বাসিন্দারা কোথায় থাকবেন, কী খাবেন— এ সব ভাবেনি প্রশাসন। গাড়ুই নদী অবিলম্বে সংস্কার না করলে বিপদে পড়তে চলেছি আমরা।’’
হুগলিতে বুধবার থেকে চলছে টানা বৃষ্টি। তার জেরে ব্যান্ডেল, চুঁচুড়ার বিভিন্ন জায়গা এখন জলের নীচে। ব্যান্ডেল সাবওয়ে, ক্যান্টিন বাজার, লোকোপাড়া, কোদালিয়া, নলডাঙা, চুঁচুড়ার তিন নম্বর ওয়ার্ড, লিচু বাগান, গ্রিন পার্ক, মিলিটারি কলোনি জলমগ্ন। জল জমেছে চুঁচুড়া স্টেশন, পীরতলা, নবাববাগান, পেয়ারাবাগান-সহ একাধিক নিচু এলাকায়। জলের সঙ্গে ভোগান্তি বৃদ্ধি করেছে বেহাল সড়ক। একটু বৃষ্টি হলেই জল জমছে রাস্তার খানাখন্দে। স্কুলে যেতে সমস্যায় পড়ছে পড়ুয়ারা। বিজেপির দাবি, প্রশাসনকে জানিয়ে কোনও সুরাহা হয়নি। দাদপুরে রাস্তায় ধানের চারা রোপণ করে প্রতিবাদ জানায় বিজেপি। রাস্তার জমা জলে স্নান করে অবরোধও করে। দাদপুর থানার পুলিশ এসে হটিয়ে দেয় বিজেপি কর্মীদের।
অন্য দিকে, পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের ঝুমি নদীতে ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে জল। জলস্রোতে ভেঙে পড়েছে লোহার কাঠামোযুক্ত বাঁশের একটি সাঁকো। যার ফলে বৃহস্পতিবার রাত থেকে হুগলি জেলার কিশোরচক, মাধবচক, খড়কপুর, বাঘানালা, দৌলতচক, বনহরিসিংহপুর-সহ বেশ কয়েকটি গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে ঘাটালের। নদী পারাপারের জন্য আপাতত নৌকাই ভরসা স্থানীয়দের।
লাগাতার বৃষ্টির কারণে জলমগ্ন বীরভূমের নানুর এবং লাভপুরের বেশ কিছু অংশ। ফতেপুরের কাছে নানুর-বোলপুর রাজ্য সড়কে জমেছে জল। সে কারণে টোটো, অটো এবং মোটরসাইকেল যাতায়াত করতে পারছে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পার করে দিচ্ছে ছোট গাড়ি। মণিগ্রাম, মান্দার, বেলগ্রাম-সহ প্রায় পাঁচটি গ্রাম জলের নীচে। পাশাপাশি, নানুরের বন্দর এলাকাতেও জল জমেছে। গ্রামবাসীরা জেসিবি ভাড়া করে নালা পরিষ্কার করেছেন। আঙুল তুলেছেন প্রশাসনের দিকে।
বীরভূমের সিউড়ি ২ নম্বর ব্লকের অন্তর্গত ধইটে গ্রামের কাছে চন্দ্রভাগা নদীতে ভেঙে পড়েছে সেতু। এই সেতু পেরিয়ে সিউড়ি যাওয়ার প্রধান সড়কে ওঠেন জানুরি, কোমা, ভগীরথপুর-সহ বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা। সেটি ভেঙে পড়ায় বিপাকে সাধারণ মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রশাসনকে বার বার বলা সত্ত্বেও বড় সেতু তৈরি করা হয়নি। কিছু দূরে বিকল্প একটি সেতু রয়েছে। তবে সেটিও ডুবে গিয়েছে। ক্রমাগত বৃষ্টির কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে কোপাই নদীর জল। তার ফলে বোলপুরে গোয়ালপাড়া সেতু ডুবে গিয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে কেউ যাতে পারাপার না করেন, সে জন্য মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। বোলপুরের সতীপীঠ কঙ্কালীতলাতেও জমেছে একহাঁটু জল। ইলামবাজার থানার অন্তর্গত মহেশাপুর গ্রামে রাস্তায় নেমেছে ধস। সেচখালে বৃদ্ধি পেয়েছে জলস্তর। তা পার হওয়ার সময় ভেসে গিয়েছে একটি গাড়ি।
একই ছবি বাঁকুড়াতেও। ক্রমাগত বৃষ্টির কারণে জলমগ্ন একাধিক সড়ক, সেতু। ভেঙে পড়েছে কাঁচা বাড়ি। আবহাওয়া দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বাঁকুড়া জেলায় বৃষ্টি হয়েছে ৯৮ মিলিমিটার। এই বৃষ্টিতে জলস্তর বৃদ্ধি পেয়েছে গন্ধেশ্বরী, দ্বারকেশ্বর, শিলাবতী, কংসাবতী নদীর। দ্বারকেশ্বর নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় শুক্রবার জল জমেছে বাঁকুড়া শহর লাগোয়া মীনাপুর কজওয়েতে। সেখানে জলের উচ্চতা প্রায় চার ফুট। এই কজওয়ে দিয়ে বাঁকুড়া শহরে যাতায়াত করেন বাঁশি, আড়ালবাঁশি, জামবনি-সহ বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁরা এ বার বিপাকে পড়েছেন। দ্বারকেশ্বরের অন্যতম প্রধান উপনদী ডাংরায় জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়া জেলার সংযোগকারী সড়কে দু’টি সেতুতে জল জমেছে। ফলে যান চলাচল বন্ধ। জামথোল সেতুতে জল জমায় জোড়হীরা মণিহারা সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অন্য দিকে, আড়রার কাছে অন্য একটি সেতুর উপর দিয়ে জল বইতে থাকায় ছাতনা কাশীপুর সড়কেও যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
বাঁকুড়ার মেজিয়া রেল কলোনিতে শুক্রবার পাঁচ থেকে ছয় ফুট উচ্চতা পর্যন্ত জল জমেছে। সে কারণে সমস্যায় পড়েছেন এলাকার মানুষজন। কিছু বাড়ির এক তলা জলের নীচে। অনেকেই আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। স্থানীয় একটি খালের জল ঢুকে জলবন্দি হয়ে পড়েছেন কোতোলপুর ব্লকের ব্রহ্মডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দারা। লাগাতার বৃষ্টিতে জেলা জুড়ে বহু কাঁচা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁকুড়ার জেলাশাসক সিয়াদ এন বলেন, ‘‘পরিস্থিতির উপর আমরা সর্ব ক্ষণ নজর রেখেছি। কিছু সেতু জলের তলায় চলে গিয়েছে। নিরাপত্তার কথা ভেবে ওই সেতুগুলিতে যান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। প্রতিটি ব্লকের প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। জেলা এবং ব্লক স্তরে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। তৈরি থাকতে বলা হয়েছে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকেও।’’
পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার বাজার-সহ সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত। বর্ধমান-কাটোয়া রাজ্য সড়কের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে জলস্রোত। ভাতার বাজারের বেশ কয়েকটি পাড়ায় বাসিন্দারা গৃহবন্দি হয়ে পড়েছেন। ভাতার, বলগোনা, মুরাতিপুর প্রভৃতি বাজার এলাকায় দোকানপাটেও ঢুকেছে জল। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে এলাকা বিদ্যুৎহীন। ভাতারের কুমারুন গ্রামে গোয়াল ভেঙে ছ’টি গবাদি পশু মারা গিয়েছে । কিছু কাঁচা বাড়িও ভেঙে পড়েছে। এক রাতের প্রবল বৃষ্টিতে ভাসছে গুসকরা শহরও। পুর এলাকার সাতটি ওয়ার্ড জলমগ্ন। বাজেপ্রতাপপুর ও সংলগ্ন এলাকায় বহু মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম বসন্তপুর সিলুটের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নালা সংস্কারের দাবিতে পূর্ব বর্ধমানের বাদশাহি রোড অবরোধ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোলের কল্যাণপুর হাউজিং অবস্থিত গাড়ুই নদীর উপরে যে সেতুটি রয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে একটি চার চাকার গাড়ি চালকসহ নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। আসানসোল রেলপাড়ের দিকে চলে যায়। ইতিমধ্যেই উদ্ধারকারী দল গাড়িটি উদ্ধার করার জন্য ঘটনাস্থলে এসেছে। আসানসোলের কন্যাপুর মোর থেকে কল্যাণপুর হাউসিং এর দিকে এই গাড়িটি আসছিল। গাড়ুই নদীর উপরে যে ব্রিজ ছিল তার ওপর দিয়ে জলের স্রোত ছিল খুবই বেশি। স্থানীয়দের কাছে জানতে পারা যায় গাড়িটি বেক করতে গিয়ে সেভাবে আর সরতে পারেনি গাড়ির চালক। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ুই নদীর জলের তলে তলিয়ে যায়। গাড়ির মধ্যে কজন ছিল সেটা এখনো জানতে পারা যায়নি। উদ্ধার হবার পরই জানা যাবে।।
টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত নদিয়ার সদর কৃষ্ণনগর। শহরের নিচু এলাকায় ভাগীরথী নদীর জল প্রবেশ করে সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কোথাও হাঁটুজল, কোথাও কোমরজল। অন্য দিকে, টানা বৃষ্টির জেরে ধ্বস নেমেছে ১২ নম্বর জাতীয় সড়কের সার্ভিস রোডে। কৃষ্ণনগরে আজাদ হিন্দ সড়ক, পোস্ট অফিস মোড়, কাঁঠালপোতার মতো কিছু নিচু এলাকায় জল জমেছে। তাহেরপুর শহরের বড় বাজার এলাকাও জলমগ্ন। একই অবস্থা দেখা গিয়েছে নবদ্বীপ শহরেও। শান্তিপুর পুরসভা, রানাঘাট, চাকদহ এবং কল্যাণীর বেশ কিছু ওয়ার্ডও জলমগ্ন হয়ে রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy