আনন্দের শপথে শাসক-বিরোধী দ্বৈরথ প্রকাশ্যে।
বাংলার রাজনীতিতে শাসক-বিরোধীর সম্পর্ক যে ‘অতীব মধুর’, তা জেনেই সিভি আনন্দ বোস কেরল থেকে রাজ্যপালের দায়িত্ব নিতে এসেছেন। কিন্তু তাঁর শপথগ্রহণের দিনেই যে সেই রাজনীতি এমন প্রকট হয়ে উঠবে, তা সম্ভবত তিনি ভাবেননি!
কিন্তু নতুন রাজ্যপালের অভিজ্ঞতা তেমনই হল। প্রথম সারিতে আসন না দিয়ে তাঁকে ‘অপমান’ করা হয়েছে বলে রাজ্যপালের শপথে গরহাজির থাকলেন স্বয়ং বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। যা সাম্প্রতিক অতীতে এ রাজ্যে দেখা যায়নি। আমন্ত্রণ পেয়ে রাজভবনে এসেও সেই ‘অপমানিত’ হওয়ার অভিযোগ তুলেই অনুষ্ঠানে থাকলেন না বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা সাংসদ সুকান্ত মজুমদার। যে বিতর্ক আরও বাড়িয়ে দিয়ে শাসক তৃণমূলের দাবি করছে, ‘অসৌজন্য’ দেখিয়েছে বিরোধী বিজেপি।
শুভেন্দুর দাবি, বিরোধী দলনেতা হিসাবে তিনি পূর্ণমন্ত্রীর সমান গুরুত্বের অধিকারী। সেই হিসাবে শপথ অনুষ্ঠানে প্রথম সারিতেই তাঁর আসন থাকা উচিত। কিন্তু তাঁর আসন বরাদ্দ ছিল দ্বিতীয় সারিতে। সুকান্তের অভিযোগ, তৃণমূলের সাংসদরা আমন্ত্রণ পেলেও বিজেপির সাংসদরা ডাক পাননি। রাজভবনে ঢোকার মুহূর্তে তৃণমূল সাংসদরা ওই শপথে থাকছেন এবং কেউ কেউ প্রথম সারিতে বসছেন জেনে তিনিও শপথ বয়কট করেন।
রাজভবন সূত্রে খবর, রাজ্যপালের শপথে কাকে কোথায় বসতে দেওয়া হবে, তার কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। রাজ্যের প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের আবদুল মান্নান বুধবার আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘বিরোধী দলনেতাকে প্রথম সারিতেই বসতে দিতে হবে, এমন কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে সেটাই চালু রীতি। সেই ব্যবস্থা না রাখা ঠিক হয়নি।’’ প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের শপথের দিন তৎকালীন বিরোধী দলনেতা হিসাবে তাঁকে প্রথম সারিতে বসতে দেওয়া হয়েছিল বলেও জানান মান্নান।
রাষ্ট্রপতির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে কোন পদাধিকারী কতটা গুরুত্ব পাবেন তা অবশ্য লিখিত ভাবে উল্লেখ রয়েছে। তাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদের সমান গুরুত্ব দেওয়া রয়েছে লোকসভা ও রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতাকে। সেই গুরুত্ব অনুযায়ী আসনও নির্দিষ্ট করা হয় বলে জানিয়েছেন প্রশাসনিক মহলের একাংশ। তাঁরা এটাও জানিয়েছেন যে, রাজ্যপালের শপথের ক্ষেত্রেও একই রীতি মানা হয়। সেই ‘প্রোটোকল’ দেখিয়েই বিজেপি শিবিরের দাবি, রাজ্য অপমান করেছে বিরোধী দলনেতাকে। কারণ, ওই ক্রম অনুযায়ী তাঁর আসন হওয়ার কথা সামনের সারিতেই। পূর্ণমন্ত্রীর সমান মর্যাদার বিরোধী দলনেতার আসন কখনওই সাংসদদের পিছনের সারিতে হতে পারে না।
বুধবার আনন্দের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বিশিষ্টদের বসার বন্দোবস্তে প্রথম সারির প্রথমেই ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসন। তাঁর ডান পাশে যথাক্রমে বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। প্রথম সারিতে জায়গা পেয়েছিলেন তৃণমূলের তিন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মালা রায় এবং কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
রাজ্যপালের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান রাজভবনে হলেও তার আয়োজন করে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর। ঘটনাচক্রে, যা মুখ্যমন্ত্রী মমতার অধীন। ফলে বিজেপি শিবিরের একাংশের বক্তব্য, বিরোধী শিবিরের শুভেন্দু বা সুকান্তের আসন বণ্টন হয়েছে সেই দফতরের নির্দেশেই। যদিও নবান্ন সূত্রের বক্তব্য, শপথ অনুষ্ঠানে কাকে কোথায় বসতে দেওয়া হবে, তার কোনও নির্দিষ্ট ‘প্রটোকল’ নেই। নিয়মও নেই। যা আছে, তা হল রীতি বা রেওয়াজ। সেই রেওয়াজ মানতেই হবে, তেমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তবে রীতি মানলেও কিছু বলার নেই।
এখানেই প্রশ্ন যে, দিদি কেন নতুন রাজ্যপালের সামনে তাঁর প্রথম ওভারের প্রথম বলটাই ‘বাউন্সার’ দিয়ে শুরু করলেন! তাঁদের বক্তব্য, মমতা ‘আইনবিরুদ্ধ’ কিছু করেননি। কিন্তু প্রচলিত রীতি ভেঙেছেন। যেমন ক্রিকেটে কোনও বোলার দিনের প্রথম ডেলিভারিটাই বাউন্সার করলে তিনি আইনবিরুদ্ধ কিছু করবেন না। কিন্তু ‘ভদ্রলোকের খেলা’ বলে পরিচিতি ক্রিকেটে তা এক ধরনের ‘অসৌজন্য’ বলেই অভিহিত করা হবে। যাকে প্রশাসনিক মহলের একাংশ নতুন রাজ্যপালের শপথ অনুষ্ঠানে রাজভবনে আসন বন্টনের সঙ্গে তুলনা করতে চাইছেন।
কিন্তু এই বিবিধ ব্যাখ্যার মধ্যেও যে প্রশ্নটি থেকে যাচ্ছে, তা হল— কেন এমন হল? অনেকে বলছেন, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর সঙ্গে একই সারিতে বসতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনাচক্রে, ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে গোটা রাজ্যে তৃণমূল বিপুল ভাবে জিতলেও নন্দীগ্রামে শুভেন্দুর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন মমতা। যা নিয়ে তৃণমূল আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছে। পরে ভবানীপুর আসন থেকে উপনির্বাচনে জিতে আসেন মমতা।
শুভেন্দু বরাবরই নন্দীগ্রামের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মমতাকে ‘কম্পার্টমেন্টাল চিফ মিনিস্টার’ বলে কটাক্ষ করে আসছেন। অর্থাৎ, নন্দীগ্রামের মূল পরীক্ষায় পাশ না করে ভবানীপুরের ‘কম্পার্টমেন্টাল’ পরীক্ষায় পাশ করেছেন মমতা। ফলে দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই অহি-নকুল।
রাজ্য বিধানসভার মধ্যেও মমতা-শুভেন্দু বাক্যালাপ হয় না। ঘটনাচক্রে, মমতা বুধবারেও রাজ্য বিধানসভায় বিরোধীদের আক্রমণ করতে গিয়ে শুভেন্দুর নাম মুখে আনেননি। বলেছেন, ‘‘এদের নাম মুখে আনতে আমার ঘৃণাবোধ হয়।’’ অতীতের বিভিন্ন সরকারে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধী দলনেতার যে একটা ‘জলচল’ ছিল (এমনকি, মমতা ক্ষমতায় আসার পরেও ছিল), মমতা তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর তা একেবারেই উধাও হয়ে গিয়েছে। অনেকের ধারণা, এর মূল কারণ বিরোধী দলনেতার আসনে শুভেন্দুর থাকা। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যপালের শপথে শুভেন্দুর সঙ্গে মমতা একই সারিতে বসে তাঁকে নিজের ‘সমকক্ষ’ করতে চাননি বলেই অনেকের ব্যাখ্যা। আবার অন্য অনেকে বলছেন, এর মধ্যে ‘রাজনীতি’ খোঁজার কিছু নেই। এমন নয় যে, শুভেন্দুকে সকলের পিছনে বসতে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে যথেষ্ট ‘সম্মানজক’ আসনই দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করবেন বলেই শুভেন্দু আসেননি। তবে শপথের পরে রাজভবনে গিয়ে নতুন রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসেন বিরোধী দলনেতা। রাজভবন থেকে বেরিয়ে তিনি যদিও বলেছেন, শুধু দেখাই করেছেন। কোনও অভিযোগ জানাননি। কিন্তু অনেকেরই অনুমান, শুভেন্দু মুখ্যমন্ত্রী মমতা এবং তাঁর সরকার সম্পর্কে কিছু ‘মধু’ একান্তে বর্ষণ না করে কি আর থেকেছেন!
শপথে তাঁর না আসার কথা আগেই টুইট করে জানিয়েছিলেন শুভেন্দু। অনুষ্ঠানে রাজভবনের আসন বিন্যাসের যে ছবি তিনি পোস্ট করেছিলেন, তা দেখিয়ে শুভেন্দু দাবি করেন, রাজ্যের বিরোধী দলনেতাকে জায়গা দেওয়া হয়েছে তৃণমূল সাংসদদেরও পিছনের সারিতে। শুভেন্দুর আরও অভিযোগ ছিল, তাঁর পাশে আসন দেওয়া হয়েছিল বিজেপির টিকিটে জিতে বিধায়ক হয়ে তৃণমূলে যাওয়া বনগাঁর বিশ্বজিৎ দাস এবং রায়গঞ্জের কৃষ্ণ কল্যাণীকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতার ‘খামখেয়ালিপনা’র জেরেই এমন হয়েছে বলে শুভেন্দুর অভিযোগ। তাঁর বক্তব্য, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ’ করার জন্যই তাঁকে ‘অপমান’ করা হয়েছে।
তৃণমূলের তরফে সরাসরি এর উত্তর দেওয়া হয়নি। তবে দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ টুইট করেন, ‘‘রাজ্যপালের শপথে নেই। টুইটে অসৌজন্য ও মিথ্যাচার শুভেন্দুর। যে সরকার ও দলে ও মন্ত্রী-সাংসদ-অজস্র পদাধিকারী ছিল, তার বিরুদ্ধে কুৎসা, নাটক করছে শুধু নিজেকে সিবিআই, ইডি থেকে বাঁচাতে। সিবিআইয়ের এফআইআরে নাম থাকা চোর, তোলাবাজ, ব্ল্যাকমেলার শুভেন্দু সম্পর্কে সব তথ্য রাজ্যপালকে যথা সময়ে দেওয়া হবে।’’
ঘটনাচক্রে, আনন্দের শপথগ্রহণে আমন্ত্রিত ছিলেন সস্ত্রীক প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। যাঁদের প্রথম সারিতেই বসতে দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাস বলছে, গোপালকৃষ্ণ রাজভবনে থাকাকালীন এই রাজ্য শাসক-বিরোধীর পারস্পরিক সম্পর্কের সবচেয়ে টালমাটাল সময় দেখেছে। কিন্তু তাঁর সময়েও শাসক-বিরোধী সিঙ্গুর সমস্যা মেটাতে মুখোমুখি আলোচনায় বসেছিল। বুধবার রাজভবনে যা ঘটল, প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, তা খুব ‘সুখকর’ নয়। সবচেয়ে বড় কথা, পুরো বিষয়টিতে জড়িয়ে গেলেন নতুন রাজ্যপাল। কারণ, তাঁর শপথ অনুষ্ঠান ঘিরেই যা ঘটার ঘটেছে। সম্ভবত প্রথম দিনেই তিনি আঁচ পেয়ে গিয়েছেন, তাঁর আগামী দিনগুলি কেমন হতে চলেছে। ময়দানে তিনি নামা মাত্রই খেলা শুরু!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy