মজুরির অপেক্ষায় রয়েছেন একশো দিনের প্রকল্পের অনেক শ্রমিক। প্রতীকী ছবি।
আমপানে দরমার বেড়া দেওয়া মাটির বাড়ির চাল উড়ে গিয়েছিল তাহের আলি মোল্লার। এ বার আবাস যোজনায় চূড়ান্ত তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। কিন্তু এখনও টাকা মেলেনি। এরই মধ্যে বৃষ্টিতে ঘর আবার জলমগ্ন। তাহেরের কথায়, ‘‘পঞ্চায়েতে গেলে বলছে, কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না। আমরা গরিব মানুষ, এত বুঝি না। টাকা না পেলে এ বারও সমস্যায় পড়তে হবে।’’
ভাঙড়ের তাহের থেকে শালবনির করুণা ভুঁইয়া, গল্পটা একই রকম। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার দ্বিতীয় দফা ‘আবাস প্লাস’ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে রাজ্য জুড়ে। পরিদর্শনে এসেছে কেন্দ্রীয় দল, সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে তালিকায়। তার পরেও অ্যাকাউন্টে এখনও টাকা আসেনি, অভিযোগ বহু উপভোক্তার। অ্যাকাউন্টে টাকা আসবে, দীর্ঘ অপেক্ষায় রয়েছেন একশো দিনের প্রকল্পের অনেক শ্রমিকও। মজুরি বকেয়া থাকায় বছরখানেক ধরে কার্যত বন্ধ সে প্রকল্প। গ্রামীণ এলাকায় সরকারি প্রকল্প চলছে এমন খুঁড়িয়েই।
রাজ্যের দাবি, একশো দিনের কাজে কেন্দ্রের কাছে তাদের পাওনা প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। যদিও ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক দাবি করে, রাজ্য ৩,২০২ কোটি টাকা পাবে। টাকা না মেটানোয় কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে আক্রমণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপি নেতাদের পাল্টা দাবি, দুর্নীতি ও উপযুক্ত হিসাব না দেওয়ার জন্য টাকা দিতে পারছে না কেন্দ্র। এই পরিস্থিতিতে, রাজ্যের প্রায় সব পঞ্চায়েতই এই প্রকল্পে নতুন কাজ হাতে নেওয়া বন্ধ রাখায় পুকুর খনন, নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কার, রাস্তার পাড় বাঁধানোর মতো নানা পরিকাঠামো তৈরির কাজ হচ্ছে না। শ্রমিকদের হাতে টাকা না আসায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিও।
একশো দিনের কাজ পরিদর্শনে রাজ্যে ঘুরে গিয়েছে কেন্দ্রীয় দল। অভিযোগ, তাঁরা অনেক জায়গায় দেখেছেন, খাতায়-কলমে কাজ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। কয়েকটি পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করেছেন তাঁরা। একশো দিনের কাজ বন্ধ থাকায়, ‘জবকার্ড হোল্ডার’দের বিকল্প কাজ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। বিভিন্ন দফতরের নানা কাজে অদক্ষ শ্রমিকদের নিযুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল। প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, ইতিমধ্যে বিকল্প সেই কাজে কয়েক কোটি কর্মদিবস তৈরি করা গিয়েছে।
গ্রামীণ এলাকায় রাস্তার হাল ফেরাতে ‘পথশ্রী’ (বাজেটে যার নাম ছিল ‘রাস্তাশ্রী’) প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রকল্পে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করার কথা। কিন্তু কয়েকটি জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, এই কাজের জন্য উপযুক্ত ঠিকাদার পাওয়া মুশকিল হচ্ছে। কারণ, এক সঙ্গে অনেকগুলি রাস্তার কাজে বিনিয়োগ করার মতো ঠিকাদার পঞ্চায়েত স্তরে পাওয়া সমস্যার। কাজ করে টাকা কবে মিলবে, সে নিয়েও সন্দিহান ঠিকাদারদের একাংশ। তাই কবে এই সব রাস্তার কাজ শেষ হবে, তা অনিশ্চিত বলে কটাক্ষ বিরোধীদের।
সম্প্রতি গ্রামীণ এলাকায় বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে আবাস যোজনা নিয়ে। আবাস প্লাসের তালিকা প্রকাশ্যে আসা শুরু হতেই তাতে তৃণমূলের নেতা-নেত্রী ও তাঁদের পরিজনদের নাম থাকা নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুরু হয়। চার তলা বাড়ি থাকা সত্ত্বেও নেতার পরিজনের নাম রয়েছে তালিকায়— এমন উদাহরণও সামনে এসেছে। আবাস যোজনার বাড়িতে নীল-সাদা রং করে রাজনৈতিক কার্যালয় চলার ছবিও ধরা পড়েছে। এ সব নিয়ে হইচই শুরু হলে, কেন্দ্রীয় দলও এসেছে পর্যবেক্ষণে। তালিকা থেকে বাদ গিয়েছে বহু নাম। যেমন, পশ্চিম মেদিনীপুরে তালিকার প্রায় ৪ লক্ষ ২৫ হাজার জনের মধ্যে যাচাই-পর্বে প্রায় ৯০ হাজার নাম বাদ পড়ে। নদিয়ায় প্রায় তিন লক্ষ নামের মধ্যে ১ লক্ষ ২৮ হাজার বাদ যায়। আবার, উত্তর দিনাজপুরে অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা প্রায় সাড়ে ৪৮ হাজার নামের মধ্যে হাজার তিনেক উপভোক্তার খোঁজ নেই প্রশাসনের কাছেই।
এমন পরিস্থিতিতে, ‘দিদির দূত’ কর্মসূচিতে গ্রামে গিয়ে ক্ষোভের মুখে পড়ছেন তৃণমূল নেতা-নেত্রীরা। রাস্তা-সহ নানা পরিকাঠামো নিয়ে সাংসদ শতাব্দী রায় থেকে বিধায়ক জুন মালিয়াদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। আবার, একশো দিনের বকেয়া মজুরির দাবিতে কেন্দ্রীয় দলকে ঘিরেও বিক্ষোভ হয়েছে। লাখখানেক টাকায় কী ভাবে বাড়ি তৈরি সম্ভব, সে প্রশ্নও শুনতে হয়েছে কেন্দ্রের পরিদর্শকদের।
গ্রামে সরকারি প্রকল্প নিয়ে এত ক্ষোভ কি আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটেও প্রভাব ফেলবে? বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের দাবি, ‘‘মানুষ দেখেছেন, তাঁদের থেকে টাকা নিয়েও ঘর, শৌচালয় করে দেওয়া হয়নি। তৃণমূল নেতারা একশো দিনের টাকা হাতিয়ে তিন তলা, চার তলা বাড়ি করেছেন। পঞ্চায়েত ভোটে মানুষ সুযোগ পেলে জবাব দেবেন।’’ তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের পাল্টা দাবি, ‘‘আবাস প্রকল্পে কেন্দ্রীয় দল ১১ লক্ষ বাড়ি নিয়ে একটি অভিযোগও পাননি। আসলে দুর্নীতির একটি কৃত্রিম আবহ তৈরি করা হচ্ছে। গ্রামের মানুষ লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, রূপশ্রী, কন্যাশ্রী পেয়েছেন। কোনও একটি প্রকল্প নিয়ে কোনও বিচ্ছিন্ন ত্রুটি হয়ে থাকতে পারে। তার মানে এটা নয়, বাকি পরিষেবাগুলি মানুষ পাননি।’’
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy