কৃষ্ণা বসুর ৯০তম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নেতাজি ভবনে সুগত বসু, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ও সুমন্ত্র বসু। শনিবার। ছবি: জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৪২ সালের কলকাতা। বারো বছরের মেয়ে কৃষ্ণা চৌধুরী (পৈতৃক পদবি, পরে বসু) সে বছর থেকে খবরের কাগজ পড়া শুরু করল। ওই বছরই গায়ত্রী চক্রবর্তীর জন্ম। কলকাতাতেই। পরে দু’জনেই প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বেন। অধ্যাপক তারকনাথ সেনের কাছে সাহিত্যপাঠের দীক্ষা নেবেন।
তাঁর ‘কৃষ্ণাদি’র নামাঙ্কিত বক্তৃতার উদ্বোধনী বক্তা হিসেবে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চিন্তাবিদ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক স্পর্শ করতে করতে যাচ্ছিলেন এই বিন্দুগুলো। যাকে তিনি বলছেন ‘রেজ়োনেন্স’, ধ্বনি-প্রতিধ্বনির অনুরণন। শনি-সন্ধ্যার কৃষ্ণা বসু স্মারক বক্তৃতা তাই একই সঙ্গে হয়ে উঠল ব্যক্তি, সময় এবং মননের পাঠ। ‘হারানো ঠিকানা পুনরুদ্ধারের’ আহ্বান।
শিক্ষাবিদ, লেখক, সাংসদ, সমাজকর্মী এবং বসু পরিবার— কৃষ্ণার জীবনে বহু বর্ণের সমাহার। গোড়ার কথায় পুত্র সুমন্ত্র বসু বলছিলেন, কৃষ্ণার বাবা চারুচন্দ্র চৌধুরী বদ্ধপরিকর ছিলেন, ম্যাট্রিক পাশ করার পরেই মেয়ের বিয়ে দেওয়া নয়। মেয়েকে তিনি গড়ে উঠতে দেবেন, প্রতিষ্ঠিত হতে দেবেন তার পরিপূর্ণ বিকাশে। কৃষ্ণা তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি সঙ্গীতের চর্চা, রাইফেল শুটিংয়ের তালিম চালিয়ে গেলেন পুরোদমে। সুগত বসু জানালেন মায়ের সেতারবাদনের কথা। বিয়ের পরেও কৃষ্ণার লেখালেখি থেকে শুরু করে সক্রিয় রাজনীতি— শিশিরকুমার বসু পাশে থেকে উৎসাহ জোগালেন পরম বন্ধুর মতো।
কৃষ্ণার এই গতিপথকেই গায়ত্রী পড়ে নিতে চাইলেন মননের সামাজিক ইতিহাসের আতসকাচে। বঙ্গীয় রেনেসাঁস শব্দবন্ধটি তাঁর নিজের খুব মনঃপূত না হলেও সেটা যে সাংস্কৃতিক আবহের দিকে নির্দেশ করে, কৃষ্ণা বসুর মতো ব্যক্তিত্ব তারই ফসল। সেখানে চিন্তা-চেতনায়— গায়ত্রীর শব্দবন্ধে— নৈতিকতার পেশিগুলি তৈরি হত মজবুত। সাহিত্যের ক্লাসঘর থেকে সামাজিক ন্যায়ের বীজমন্ত্রে বোনা হয়ে যেত যুক্তি আর কল্পনাশক্তির মিশেল। গায়ত্রী মনে করিয়ে দিলেন, কৃষ্ণা যে দৃপ্ততায় নির্ভয়াকে নিয়ে লিখেছেন, সেই একই দৃপ্ততায় লিখেছেন রোহিত ভেমুলাকে নিয়ে। শিশিরকুমারের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যে যে সাম্য ও মৈত্রীর আবাহন, লিঙ্গচেতনার পরিসরকে তা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই প্রসারিত করেছে বহু দূর। সুভাষচন্দ্র বসুর স্ত্রী-কন্যাকে সসম্মানে গ্রহণ করার মধ্যেও সেই চেতনার স্বাক্ষর।
এ বছর ছিল শিশিরকুমারের শতবর্ষ। এ বছরেরই শুরুর দিকে, ২২ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত হলেন কৃষ্ণা। কোভিডের ঝড় তখনও আছড়ে পড়েনি এ দেশে। বছর-শেষে তাঁর নব্বইতম জন্মদিন যখন পালিত হচ্ছে, তখন সকলের মুখ মাস্কে ঢাকা, দর্শকাসনে দূরত্ববিধির প্রয়োগ। নেতাজি ভবনের সভাগৃহ তবু নিমেষে বাঁধা পড়ে গেল সুরের বাঁধনে। কৃষ্ণার কণ্ঠে তখন বাজছে বিদ্যাপতির পদ— আজু রজনী হম ভাগে পোহায়লু! সেই তদ্গত গায়নের মূর্ছনাই মুখবন্ধ রচনা করে দিল গায়ত্রীর ‘অনুরণন’-কথার।
তাঁর আত্মকথনমূলক লেখাগুলি জুড়ে— কৃষ্ণা নিজেই বলেছিলেন— কলকাতা বয়ে চলেছে যেন মূল স্রোতের মতো। কৃষ্ণারই বইয়ের নাম থেকে খেই ধরে গায়ত্রী বললেন, কলকাতা নিজেই আজ বাঙালির ‘হারানো ঠিকানা’। যে ভাবনা থেকে বাঙালির লেখা নৌবিদ্রোহের গানে (রচনা হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ‘কল্লোল’ নাটকেও ব্যবহৃত) মুম্বইয়ের কথা, ভারতের কথা বলার সঙ্গে ‘কল্লোলিত নগর কলকাতা’র কথা মিশে যেত অনিবার্য ভাবে, নোঙর ফেলার সেই ঠিকানা, সেই কলকাতাকে ফিরিয়ে আনার উপরে জোর দিলেন গায়ত্রী।
ঠিকানা খোঁজা মানে জাতিদম্ভের চর্চা নয়। ঠিক যে ভাবে অতীন্দ্রিয়তার সন্ধান মানে ধর্মবিশ্বাসের অন্ধগলি নয়। কৃষ্ণাকে একজন পরিপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেই গায়ত্রী মনে করালেন তাঁর ‘ঈশ্বরের সন্ধানে’ লেখাটিকে। যেখানে কৃষ্ণা লিখেছেন ভরত মহারাজের কথা, তাঁর মনের দোলাচলের কথা। ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনাকে যদি ইউরোপ-কেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত হতে হয়, তা হলে অতীন্দ্রিয়ের অন্বেষণ এবং অন্তর্দৃষ্টির সাধনাকে অবহেলা করা চলে না। গায়ত্রী বললেন, আধ্যাত্মিক চিন্তায় বিশ্বাসের অংশটাই সবচেয়ে কম ‘ইন্টারেস্টিং’, কল্পনার অংশটাই সেখানে মহীয়ান।
ধর্মভিত্তিক বিদ্বেষ-বিষে জর্জরিত এ সময়ে গায়ত্রীর এই উচ্চারণ আর সমাপ্তিতে কৃষ্ণা-কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রশ্ন’— বহুবিধ ব্যঞ্জনার ‘অনুরণন’ তৈরি করে দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy