দুর্নীতির বোড়ে এলাকার অতি সাধারণ কিছু বাসিন্দা। ফাইল চিত্র।
স্কুলে ঘুরপথে নিয়োগের টাকা হোক বা মোবাইল অ্যাপ জালিয়াতির অর্থ, সব দুর্নীতির দাবা খেলারই বোড়ে এলাকার অতি সাধারণ কিছু বাসিন্দা। তাঁদের কারও কারও আধার-সহ বিভিন্ন কার্ড হস্তগত করে মাঝেমধ্যে দেওয়া হত ১০-১৫ হাজার টাকা। আবার কারও কারও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট কার্যত ভাড়া নিয়ে মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা দেওয়া হত নিয়মিত।
শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘কর্মপদ্ধতি’র সঙ্গে গার্ডেনরিচের অ্যাপ দুর্নীতির চাঁই আমির খানের এমনই মিল পাচ্ছেন তদন্তকারীরা। পার্থের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি চাকরি বিক্রির কোটি কোটি টাকা এমন কিছু ভুয়ো সংস্থা খুলে বিনিয়োগ করেছিলেন, যেখানে ডিরেক্টরের পদে বসানো হয়েছিল স্থানীয় নিম্নবিত্ত মানুষদের। আর গার্ডেনরিচে পরিবহণ ব্যবসায়ীর ছেলে আমিরের বাড়ি থেকে ১৭ কোটি ন’লক্ষ টাকা উদ্ধারের ঘটনাতেও উঠে এসেছে বেশ কিছু স্থানীয় যুবকের নাম, যাঁদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হত বাঁকা পথে অর্জিত টাকার সদ্গতিতে। ইডি বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের দাবি, অ্যাপ প্রতারণার মাধ্যমে রোজগার করা টাকা ওই সব যুবকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ‘ভাড়া’ নিয়ে গচ্ছিত রাখা হত। তবে শুধু অ্যাপ প্রতারণার অর্থ নয়, তার মধ্যে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির টাকাও থাকতে পারে বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ।
ইডি জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত এই ধরনের ‘ভাড়া নেওয়া’ ১৬২টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিস পাওয়া গিয়েছে। ওই সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মালিকেরা খিদিরপুর, মোমিনপুর, একবালপুর ও মেটিয়াবুরুজ এলাকার বাসিন্দা। ওই অ্যাকাউন্টগুলির মাধ্যমে বিদেশেও টাকা পাচার করা হয়েছে।
ইডি-র দাবি, টাকা পাচারের ক্ষেত্রে যাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হয়েছে, তাঁদের নিয়মিত মাসে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হত। ওই অ্যাকাউন্টগুলির মাধ্যমে কিছু প্রভাবশালীর কালো টাকাও সাদা করা হয়েছে। লক ডাউনের সময় ওই সব অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের লেনদেনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
আমির ও মোমিনপুর এলাকাবাসী তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বস্ত্র-ব্যবসায়ী বন্ধু দিন দশেক আগে থেকেই ফেরার বলে খবর। দু’জনেরই মোবাইল ফোন বন্ধ। শনিবার মোমিনপুরের ওই বস্ত্র ব্যবসায়ীর বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, আমির কি তা হলে ইডি-র এই হানার কথা আগাম জানতে পেরে গিয়েছিলেন?
তদন্তকারীদের দাবি, প্রভাবশালীরা সম্ভবত মনে করেছিলেন, আমিরের বাড়িতে কালো টাকা গচ্ছিত রাখাটা নিরাপদ। যদি কোনও ভাবে সেই টাকা ধরা পড়ে যায়, সে-ক্ষেত্রে তা প্রতারণা চক্রের টাকা হিসাবে চিহ্নিত হবে এবং সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উপরে নজর পড়বে না। সেই জন্যই আমিরের বাড়িতে টাকা রাখা হয়েছিল বলে তদন্তকারীদের অনুমান। তার উপরে আমিরের বাবা নিসার খানের পরিবহণ ব্যবসা রয়েছে। ফলে, অভিযোগের তির সহজেই ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে আমিরদের দিকে।
ইডি সূত্রের খবর, আমিরের দোতলার ঘরে সব থেকে বেশি পাওয়া গিয়েছে ৫০০ টাকার নোট। সব থেকে পুরনো নোটের বয়স কমবেশি আট বছর, সেগুলি ২০১৪ সালে ছাপা ১০০ টাকার নোট। ২০২১ সালের নোট খুবই কম। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সিল দেওয়া নোটের বান্ডিলও ছিল কিছু। তদন্তকারীদের বক্তব্য, নোটগুলি খুব বেশি দিন আগে ওই খাটের নীচে প্লাস্টিকের মুড়ে ঢোকানো হয়নি। সে-ক্ষেত্রে আর্দ্রতায় নোট খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। ১০০ আর ২০০ টাকার নোটের বান্ডিল ছিল তুলনায় কম ছিল। সম্ভবত দিন পনেরো আগে দোতলার ঘরে আনা হয়েছে।
ইডি জানিয়েছে, প্রায় পাঁচ বছর ধরে খিদিরপুর, একবালপুর ও মেটিয়াবুরুজ এলাকার শ’দেড়েক যুবককে নিয়ে প্রতারণা চক্র তৈরি করেন আমির। মাস চারেক আগে একবালপুরে একটি আবাসনে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে কম্পিউটার সেন্টার খোলা হয়ছিল। একটি সূত্রের খবর, আমির সেখানে অ্যাপ প্রতারণার কারবার চালাচ্ছেন জেনে রাজ্যের শাসক দলের স্থানীয় এক নেতা-প্রোমোটারের সঙ্গে তাঁর বচসা হয়। তিনি আমিরকে ওই ফ্ল্যাট ছাড়তে বাধ্য করিয়েছিলেন। সেই ঘটনার পরে সংশ্লিষ্ট নেতাকে দলের উচ্চ মহল থেকে ভর্ৎসনা করা হয়েছিল বলেও ওই সূত্রের খবর।
আমির যে অনলাইন অ্যাপের গেমে জড়িত ছিলেন, জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তাঁর বাবা নিসার ও দাদা তা স্বীকার করেছেন বলে তদন্তকারীদের দাবি। তবে আমিরের দোতলার ঘরে গচ্ছিত বিপুল পরিমাণ টাকা সংক্রান্ত প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দেননি তাঁরা। অভিযোগ, প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছিল নিত্য যোগাযোগ ছিল আমিরের। ইডি সূত্রের খবর, সম্প্রতি আমির-ঘনিষ্ঠ কিছু প্রভাবশালী নাকি একবালপুর ও খিদিরপুর এলাকায় কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি কেনেন তাঁর মাধ্যমেই।
তদন্তকারীদের ব্যাখ্যা, আমির নিজের বাড়িতে কমই থাকতেন। অধিকাংশ সময় থাকতেন কলকাতা ও শহরতলিতে বেনামে ভাড়া নেওয়া বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটে। নিউ টাউনে তাঁর এক বান্ধবীর নামে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া আছে। শনিবার সেই ফ্ল্যাটে হানা দিয়ে কয়েকটি বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। আমিরের ঘরেও কিছু ল্যাপটপ ও নানা ব্যাঙ্ক নথি পাওয়া গিয়েছে বলে জানান তদন্তকারীরা।
ইডি-র দাবি, সম্প্রতি আমির-ঘনিষ্ঠ এক যুবক তৃণমূলকর্মী খিদিরপুর উড়ালপুলের নীচে সরকারি সম্পত্তির একাংশ দখল করে দলীয় পার্টি অফিস তৈরি করেছেন। বন্দর এলাকার এক কাউন্সিলর বলেন, ‘‘নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে তৃণমূল নেত্রীর সভায় এলাকার বাছাই করা কয়েক জন স্থানীয় নেতাকে আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়েছিল। দলের কোনও পদে না-থাকা সত্ত্বেও আমির-ঘনিষ্ঠ সেই যুবককেও আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy