Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Cancer Research

বঙ্গতনয়া লড়ছেন ক্যানসার রোগের বিরুদ্ধে, মায়ের যুদ্ধ সামাজিক ক্যানসারের সঙ্গে

তরুণী গবেষকের মা জানালেন, মেয়ের বিয়ে না হওয়া নিয়ে যে ভাবে তাঁকে প্রশ্ন শুনতে হয়েছে, তা প্রায় গণহেনস্থার সমান। মেয়ের অক্সফোর্ড যাত্রাকে সেই ক্ষতের উপর প্রলেপ হিসাবেই দেখছেন তিনি।

A photograph of Oxford university and

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গলব্লাডার ক্যানসারের নানান দিক নিয়ে বক্তৃতা করতে চলেছেন এলিজ়া দত্ত। ছবি: সংগৃহীত।

শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৩ ১৩:০৮
Share: Save:

সপ্তম শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই মেয়েটি ঠিক করে নিয়েছিল, বিজ্ঞানী হবে। দিদিমা মারা গিয়েছিলেন গলব্লাডারের ক্যানসারে। সেই ঘটনা মেয়েটির লক্ষ্যকে আরও নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। স্কুলজীবনেই ভেবে রেখেছিল, গবেষণা করবে গলব্লাডারের ক্যানসার নিয়ে।

তার পর মেয়েটি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পৌঁছেছে। কলেজের চৌকাঠ ডিঙিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়। ৩০ বছর বয়স হওয়ার আগেই পিএইচডি শেষ। আরও আরও ধাপ পেরিয়ে সে মেয়ে এখন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেলথ’-এর সহকারী অধ্যাপক। অসমের একটি ক্যানসার হাসপাতালে কর্মরত। গলব্লাডার ক্যানসার নিয়েই কাজ করছেন এলিজ়া দত্ত। যেমন ঠিক করে ফেলেছিলেন স্কুলে পড়তে পড়তে। এলিজ়ার বাড়ি হুগলির বৈদ্যবাটিতে। সোমবার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গলব্লাডার ক্যানসারের নানান দিক নিয়ে বক্তৃতা করবেন তিনি।

দিন কয়েক আগেই কলকাতা থেকে লন্ডনে পৌঁছেছেন এলিজ়া। প্রথমে ‘লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন’-এর গবেষকদের সঙ্গে তাঁর গবেষণা, ভারতে গলব্লাডার ক্যানসারের প্রকোপ, প্রতিরোধের উপায় এবং পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করেছেন। মাঝে মিটিয়েছেন গবেষণা সংক্রান্ত আরও কাজ। সোমবার তাঁর ‘অক্সফোর্ড অভিযান’।

বিলেত রওনা হওয়ার আগে আনন্দবাজার অনলাইনের মুখোমুখি হয়েছিলেন এলিজ়া। বাবা কল্যাণ দত্ত প্রতিরক্ষা দফতরের অবসারপ্রাপ্ত কর্মী। ছোট থেকেই পড়াশোনা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে। বাবার বদলির চাকরি হওয়ার সুবাদেই ভিন্ রাজ্যেও থাকতে হয়েছে। পুণের ফার্গুসন কলেজ থেকে স্নাতক। পুণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়ের জোরে স্নাতকোত্তরের অব্যবহিত পরেই বিশ্ববদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ফেলোশিপ পেয়ে যান এলিজ়া। তার পর তাঁর জন্য খুলে গিয়েছিল বড় চাকরির দরজা। কলকাতার নাইসেডে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন এই বাঙালি তরুণী। কিন্তু নিশ্চিন্ততার মায়া কাটিয়ে সেখান থেকে বেরিয়েও এসেছিলেন। এলিজ়ার বাবা কল্যাণ বলছিলেন, ‘‘সেই সময়টা কেটেছিল মন আর মাথার দ্বন্দ্বে। নিরাপত্তার চাকরি নাকি গবেষণা?’’ শেষ পর্যন্ত মেয়ে সিদ্ধান্ত নেন, চাকরি ছাড়বেন। এগোবেন গবেষণার দিকে। বাধা দেয়নি পরিবারও। এলিজ়া বলছেন, “ওটাই ছিল আমার সঠিক সিদ্ধান্ত।”

তরুণী গবেষক তথা অধ্যাপক জানিয়েছেন, ভারতের মধ্যে পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে গলব্লাডারের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার সর্বাধিক। যা সারা বিশ্বে দ্বিতীয়। শীর্ষে লাতিন আমেরিকার ছোট্ট দেশ চিলি। এলিজ়ার কথায়, “এখনও পর্যন্ত গবেষণায় গলব্লাডার ক্যানসারের কারণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি, যা থেকে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। তবে কিছু দিক উল্লেখযোগ্য। তার মধ্যে অন্যতম জল-হাওয়া, আর্সেনিক এবং সর্ষের তেল।” তিনি আরও বলেন, “উত্তর ভারত বা পশ্চিম ভারতের মানুষের ক্ষেত্রে গলব্লাডারের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার নগণ্য। আবার অসম এ ব্যাপারে সবার উপরে। আবার পূর্ব বা উত্তর-ভারতে জন্মানো কেউ যদি খুব ছোট বয়সে দেশের অন্যপ্রান্তে চলে যান, তাঁদের মধ্যেও গলব্লাডার ক্যানসার দেখা যাচ্ছে। এমন উদাহরণও আছে।”

তাঁর গবেষণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এলিজ়া বলেন, “গলব্লাডার ক্যানসারে আক্রান্তদের আনুপাতিক হার কষতে গেলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে চার জন মহিলা। সেই মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তাঁরা দুই বা তার বেশি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।” এই সবগুলিকেই ‘সূচক’ হিসাবে দেখাতে চেয়েছেন এলিজ়া। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘‘পশ্চিমী দুনিয়ার কাছে এই সমস্যা গুরুতর নয়। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের স্বার্থেই খোলামেলা আলোচনা করে, তাঁদের সহযোগিতা নিয়ে প্রতিরোধের পথে এগোতে হবে।” রোজ মারণরোগ-দেখা গবেষক বলছেন, “গলব্লাডারের ক্যানসার সাংঘাতিক। ধরা পড়ার পর আয়ু বড়জোর এক বছর।” নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে এলিজা বলেন, “আমি যাঁদের দেখেছি, তাঁদের ছ’মাসের মধ্যেই প্রাণ গিয়েছে।”

এলিজ়ার সঙ্গে কথা বলার সময় ছিলেন তাঁর মা পূর্ণিমা। মেয়ের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন করতেই দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এল তাঁর। তার পর বললেন, “সমাজে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। যেখানে গিয়েছি, সবাই ছেঁকে ধরে জিজ্ঞেস করেছে, মেয়েটার বিয়ে দেবে না? আর কবে দেবে! শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। মেয়ের এই অক্সফোর্ড যাওয়া আমার কাছে অন্যরকম তৃপ্তির। জ্বালা জুড়ানোর মতো।”

অন্য বিষয়গুলি:

Cancer Oxford University Cancer Hospital Cancer Fight
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy