প্রতীকী ছবি।
মুর্শিদাবাদের শেখপাড়া সীমান্ত ছুঁয়ে মোহনগঞ্জের দরগাতলা। বছর তিনেক হল গ্রামের মানুষ দরগাতলার একটা ডাক নাম রেখেছেন, ‘কার্গিল’! চারপাশে চোখ বুলিয়ে সেই হদ্দ গ্রামের সিরাজুল শেখ ফিসফিস করে বলছেন, ‘‘যুদ্ধটা তো এই দরগাতলাতেই হয়েছিল স্যর!’’ পাচারকারী বনাম বিএসএফ, সে ‘যুদ্ধ’ এখনও মনে রেখেছে মোহনগঞ্জ। যুদ্ধের দু’দিন পরেও পদ্মা-পাড়ে লেপ্টে ছিল বারুদের গন্ধ, কচু পাতায় রক্তের ছিটে। দরগাতলা সেই থেকে বদলে গিয়েছে— মোহনগঞ্জের কার্গিল! সিরাজুল বলছেন, ‘‘সেই কার্গিল-যুদ্ধের কারবারিদের কাজ-কামে কোনও ভাটা পড়েনি।’’ মোহনগঞ্জ চুপি চুপি জানিয়ে দিচ্ছে, বিএসএফ এ দিক তেমন আসে না। গরু চরানো কিংবা ধান কাটার নামে চর পেরিয়ে কারবারও তাই ফের চালু হয়ে গিয়েছে।
বর্ষার মুখে পাট গাছ লকলক করে বেড়ে উঠতেই কাক-শালিখের মতো অনায়াসে পদ্মা পেরিয়ে যাচ্ছে গরু। বিএসএফের এক পদস্থ কর্তা বলছেন, ‘‘বর্ষার পাট আর শীতের কুয়াশা, এ দুটোই আমাদের সব থেকে বেশি ধোঁকা দেয়।’’ তাঁর অভিজ্ঞতা বলছে— দু-দেশের সীমান্ত ছুঁয়েই মাইলের পর মাইল পাট খেত। মাঝ-বর্ষায় তা দেড় মানুষ উঁচু হয়ে সীমান্তের রেখা প্রায় আড়াল করে দেয়। পাচারের সে এক ‘মহা সময়।’
মসজিদ পাড়ার মইদুল আলম, অধর মণ্ডলেরা (নাম পরিবর্তিত) হাসছেন—‘‘কুয়াশার টাইমে ও পারের রাজশাহী তো আমাদের হাতের মুঠোয়, বিএসএফের কিছু করার থাকে নাকি!’’ ঘোষপাড়ার ঘাটে দাঁড়িয়ে অধর ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘বর্ষায় আমাদের কাজ শুধু তো গরুগুলো চরে ঠেলে দেওয়া। বাকিটা লাইনম্যানদের কাজ।’’
পদ্মার মরা সোঁতার কোল ঘেঁষেই বিএসএফ-ব্রিজ। টোটো, অটো, সাইকেল সেতুর পাটাতন কাঁপিয়ে দেদার চলেছে। তবে সেতু পার হলেই বিএসএফের চৌকি, বৈধ-যাত্রার ইতি সেখানেই। তবে, অন্য পথও রয়েছে। সেতু থেকে নেমে মরা সোঁতার পাড় ধরে খানিক এগিয়ে গেলেই নিয়মের জারিজুরি শেষ। খোলা চর, ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’, যেন দু’হাত ছড়িয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। মূল পদ্মা শুয়ে রয়েছে তার পরেই। মোহনগঞ্জ যাকে চেনে, ‘মেন পদ্মা’ নামে।
সেই ‘অন্য পথে’, মরা পদ্মার জল আড়াআড়ি ভেঙে, চর পেরিয়ে রাজশাহীর পথে অনায়াসে পার হয়ে যাচ্ছে মানুষ থেকে গরু। ঘোষপাড়া ঘাটে দাঁড়িয়ে সেই পারাপার দেখার ফাঁকে স্থানীয় এক গ্রামবাসী বলছেন, ‘‘কাঁটাতারহীন মরা পদ্মাটুকু পার হতে পারলেই অবাধ চলাচল। তার পরে কে রোখে কাকে!’’ ভর দুপুরে মোহনগঞ্জ উজিয়ে তাই গরুর পাল চলেছে চরের মাঠে। স্থানীয় গ্রামবাসী শিবনাথ মণ্ডল বুঝিয়ে দিচ্ছেন— দিনভর চরের মাঠে চরে বেড়াবে ওরা (গরু)। তার পর বেলা পড়ে এলে নামিয়ে দেওয়া হবে ‘ডাব্বায়’। মাটি কেটে তৈরি করে রাখা নিচু জমির বাঙ্কার বা ডাব্বায় টহলদারি বিএসএফের নজর পৌঁছয় না। তার পর, ভোর রাতে তাদের নদীর বুকে ঠেলে দিতে পারলেই কাজ শেষ!
তবুও নাইট ভিশন ক্যামেরায় রাতভর টহল দেয় বিএসএফ। আর সেই টহলদারির সময়েই কিছু দিন আগে সীমান্ত প্রহরীদের চোখে পড়েছিল ভরা পদ্মায় ভেসে চলেছে অজস্র কলার ভেলা। সন্দেহ দানা বাঁধায় স্পিডবোট ঘুরিয়ে সেই কলার ভেলার কাছে পৌঁছতেই স্পষ্ট হয়েছিল কৌশলটা। বিএসএফের কাহারপাড়া ক্যাম্পের অফিসারের কথায়, ‘‘বুড়বক বনাকে ছোড় দিয়ে হামলোগোকো!’’
কলার ভেলায় আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলা হচ্ছে মাঝারি আকারের গরু। তার পর তাদের ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে নদীতে, মাঝ-নদীর দেশজ সীমারেখাটুকু পার হলেই ও পারের কারবারি এসে সেই ভেলা টেনে নিয়ে যাচ্ছে রাজশাহী ঘাটে। শুধু কলার ভেলা নয়, সেই তালিকায় রয়েছে পাটের আঁটির ভেলাও। সীমান্তের মাঠে কান পাতলে তার একটা দরও পাওয়া যাচ্ছে। বিঘা প্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিকিয়ে যাচ্ছে পাট। আর তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিব্যি তৈরি হচ্ছে একটা ভেলার আকৃতির দরিয়া পাড়ি দেওয়ার পাটাতন। পাটাতনের মাঝে শুধু মুখটুকু বের করে চার-পাঁচটি গরুকে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে পড়শি দেশের ঘাটের দিকে। সার্চ লাইট জ্বেলে সেই সব গরু বোঝাই ভেলা নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দিচ্ছে ও পারের লাইনম্যান।
বাউসমারির কাছে বাজিতপুরে সম্প্রতি ধরা পড়া কয়েকটি গরুর শিঙে পলিথিন প্যাকে মোড়া মোবাইল ফোন দেখে চমকে উঠেছিলেন বিএসএফ জওয়ানেরা। বিএসএফের এক কর্তা বলছেন, ‘‘রাতের অন্ধকারে গরুর হদিস পেতে ফোন করেন ও পারের লাইনম্যান। শিঙের ডগায় মোবাইলের স্ক্রিন রঙিন হয়ে উঠলেই ‘মালের’ (গরু) অবস্থান বুঝে যাচ্ছে ও পারের কারবারিরা। নৌকা ভাসিয়ে তাদের নদী থেকে ঘাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তারা।’’ কখনও ‘যুদ্ধ’ করে কখনও বা নব্য কৌশলে গরু পাচারের মূল কারবারি যারা, সেই ‘বড়কর্তা’দের অবশ্য সহজে কেশাগ্র স্পর্শ করার উপায় নেই সীমান্ত প্রহরীদের। জেলার এক পুলিশ কর্তার দাবি, ‘‘বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, কিন্তু পাচারের বড়কর্তাদের ছুঁলে যে সুন্দরবনে পোস্টিং!’’ শখ করে কে আর তা চায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy