বিজেপির নবান্ন অভিযানে হাওড়া ব্রিজের কাছে চলছে জলকামান। ছবি: অর্চিষ্মান সাহা।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টা। স্ট্র্যান্ড রোডের যানজটের লেজ তখন পৌঁছে গিয়েছে বেন্টিক স্ট্রিটে। রাস্তায় ইতিউতি ব্যারিকেডে থমকে রয়েছে গাড়ির চাকা। প্রায় ৬ কিলোমিটার রাস্তা বাস-ট্যাক্সি-বাইকের ভিড় ঠেলার পর শেষ পর্যন্ত স্ট্র্যান্ড রোডেই ছাড়তে হল অফিসের গাড়ি। পায়ে হেঁটে হাওড়া ব্রিজের মুখে থমকে দাঁড়াতে হল। কীসের আতঙ্কে মাথার উপর হাত তুলে যাচ্ছেন এত পথচারী! এ তো কাশ্মীর নয়। ছররা গুলিও চলেনি।
পরমুহূর্তেই কানে এল রাস্তার পাশে দাঁড়ানো পুলিশকর্মীর সতর্কবার্তা, “তাড়াতাড়ি পা চালান! বিজেপির যুব মোর্চার নবান্ন অভিযান আছে। এখনই মিছিল আসবে। রাস্তা খালি করুন! জলদি!” হাওড়া ব্রিজের মুখে পৌঁছে চোখে পড়ল রণসজ্জার বহর। লাঠিসোটা, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ার বন্দুক, জলকামান এবং দমকলের গাড়ি নিয়ে তৈরি পুলিশ বাহিনী। তার সামনে বিশেষ ধরনের অ্যালুমিনিয়ামের ব্যারিকেড। পিছনে থিকথিক করছে পুলিশ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শোনা গেল একের পর এক বোমার আওয়াজ!
অঘটন এড়াতে হাওড়া ব্রিজের কাছে ভয়ে মাথার উপর হাত তুলে রাস্তা পেরচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল, “তৈরি হও। এখানেও কিন্তু ঝামেলা হবে।” হাওড়া এবং কলকাতা পুলিশের কর্তারা অধস্তন কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করছিলেন। গত বছর লালবাজার অভিযানে চমক দিয়েছিল বিজেপি। পুলিশি বাধা কৌশলে এড়িয়ে সমর্থকেরা ঘুরপথে ঢুকে গিয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারে। পরিস্থিতি সামলাতে সেবার হিমশিম খেতে হয়েছিল পুলিশকে। এ দিনের নবান্ন অভিযানে কী রণকৌশল হবে, তা নিয়েও পুলিশ মহলেও নানা জল্পনা ছিল। স্যানিটাইজ করার জন্য রাজ্য সরকারের প্রধান প্রশাসনিক ভবন নবান্নে তালা পড়লেও বিরোধীদের একেবারে ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দিতে চায়নি প্রশাসন। হাওড়া ব্রিজে আগে থেকেই রাস্তায় একের পর এক ব্যারিকেড ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ব্রিজের মুখে অ্যালুমিনিয়ামের পাঁচিল। এক ঝলকে দেখে মনে হতে পারে যেন ‘যুদ্ধক্ষেত্র’।
হাওড়ায় পুলিশের লাঠিতে আহত বিজেপি কর্মী।
বেলা দেড়টা। দূর থেকে দেখা গেল মিছিলের মাথা। ততক্ষণে পুলিশ মাইকে ঘোষণা করতে শুরু করেছে, ‘‘এই মিছিল বেআইনি। আপনারা চলে যান। নইলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
ব্যারিকেডের ওপারে পুলিশকর্মীরা কাঁধ ঝাঁকিয়ে তৈরি হয়ে নিলেন। মাথায় হেলমেট, মুখে মাস্ক। উল্টোদিকে মিছিলের পুরোভাগে যুবকদের ভিড়। হাতে বিজেপির দলীয় পতাকা। মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান। সঙ্গে রাজ্য সরকার, তৃণমূল আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে হুঙ্কার— “এ সরকার আর চলবে না। শিল্প চাই। চাকরি চাই।” পুলিশকে সরকারের ‘দালাল’ বলতেও শোনা গেল মিছিলকারীদের। আচমকাই মিছিলের স্রোত আছড়ে পড়ল ব্যারিকেডের উপর। দেখা গেল, সর্বশক্তি দিয়ে সেই জনস্রোত আটকানোর চেষ্টা করছেন পুলিশকর্মীরা। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের অনেকে ব্যারিকেড বেয়ে উঠে পড়ার চেষ্টা করছেন। ভিড়ের স্রোত ব্যারিকেড ধরে নাড়াচ্ছে প্রবল বেগে। একদিন থেকে ব্যারিকেড ঠেলছেন বিজেপি সমর্থকরা। অন্যদিকে থেকে প্রাণপণে উল্টো ঠেলা দিচ্ছে পুলিশ।
সাঁতরাগাছিতে চলে জল কামান।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, চালু হয়ে গিয়েছে জলকামান। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের গাড়ি তখনও অনেক পিছনে। তার মধ্যেই তাণ্ডব শুরু করে দিলেন বিজেপি সমর্থকেরা। সেটা চলল বড়জোর মিনিট দশেক। তার পর বড়বাজারের দিকে লাঠি উঁচিয়ে পাল্টা ধেয়ে এল পুলিশকর্মীরা। বেধড়ক মার শুরু হল। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল মিছিল। দেখা গেল, কেউ রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছেন। কেউ আবার পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে আবার ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করছেন।
আরও পড়ুন: বিজেপির নবান্ন অভিযানে স্তব্ধ মধ্য কলকাতা, আটক অ্যাম্বুল্যান্সও
রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে-থাকা এক মহিলা বলছিলেন, “এই গণতন্ত্র? এ ভাবে আমাদের মারল? ভোটে এর জবাব পাবে তৃণমূল।” জানা গেল, তিনি উত্তর ২৪ পরগনা থেকে এসেছেন। পায়ের ব্যথা নিয়ে রাস্তায় পড়ে সাহায্যের কাতর আবেদন করছিলেন তিনি। কিন্তু কে সাহায্য করবে? পুলিশ তো তখন মিছিল ভাঙতে ব্যস্ত! একই ছবি দেখা গেল রাস্তার অন্যধারে। সেখানে এক যুবমোর্চার নেতা প্রায় অচেতন অবস্থায় পড়েছিলেন। তাঁকে টেনে তোলার চেষ্টা করলেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকেরা। কিন্তু তাতে তাঁর হুঁশ ফিরল না। শেষে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিতে নড়ে উঠলেন। লাঠিধারী পুলিশের নজরে আনার চেষ্টা করা গেল একদফা। কিন্তু ব্যর্থ হতে হল।
স্ট্র্যান্ড রোডে যান নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ব্যারিকেড।
তখন মনে হচ্ছিল এ বারের মতো ঝামেলা শেষ হল। কিন্তু দেখা গেল, ফের স্ট্র্যান্ড রোডের দিকে থেকে মিছিলের একটি অংশ ব্রিজের অভিমুখে এগোতে শুরু করেছে। এ বার নেতৃত্বে মহিলারা। সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলেন মহিলা পুলিশ। আবার এক দফা ধস্তাধস্তি। আবার লাঠিচার্জ।
আরও পড়ুন: ইটবৃষ্টি-বোমাবাজি, উদ্ধার হল পিস্তল, বিজেপির মিছিল ঘিরে ধুন্ধুমার
দুপুর আড়াইটে। দিলীপ তখন একপাশে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক তোপ দাগছেন রাজ্য সরকার এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে। বিবৃতি দিয়ে দিলীপের গাড়ি ছাড়তেই গোটা এলাকাটা যেন ভাঙা হাট। রাস্তায় গড়াগড়ি যাচ্ছে অজস্র চটি। পড়ে আছে ভেঙে যাওয়া চশমা। বেদম মার খেয়ে কয়েকজন তখনও বসে আছেন রাস্তায়। বাকিরা মুরলীধর সেন লেনে বিজেপির রাজ্য দফতরের দিকে এগোতে শুরু করেছেন।
ছবি– অর্চিষ্মান সাহা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy