মেডিক্যাল পাঠ্যক্রম তৈরি-সহ ডাক্তারি শিক্ষার হাল তাদের হাতে। চিকিৎসকদের পেশাগত নীতি-নৈতিকতায় নজর রাখার দায়িত্বও তাদের উপরে ন্যস্ত।
এ-হেন মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া বা এমসিআইয়ের উপরেই নজরদারির জন্য একটি কমিটি গড়ে দিল সুপ্রিম কোর্ট। দেশে মেডিক্যাল শিক্ষার মান নেমে যাওয়া এবং চিকিৎসকদের মধ্যে অনৈতিক কাজকর্ম বেড়ে যাওয়ার জন্য এনসিআইয়ের কাজকর্মকেই দায়ী করেছে তারা। তিন সদস্যের নজরদার কমিটির নেতৃত্ব দেবেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি আর এম লোঢা। ওই কমিটি আগামী অন্তত এক বছর এমসিআইয়ের যাবতীয় কাজকর্মের উপরে নজর রাখবে।
শীর্ষ আদালত বলেছে, ‘‘আমরা তিন সদস্যের কমিটিকে মেডিক্যাল শিক্ষা এবং চিকিৎসকদের নিয়মে বাঁধতে সব রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দিলাম। মেডিক্যাল শিক্ষার সব দিকেই নজর রাখবে ওই কমিটি। সংশ্লিষ্ট যে-কোনও সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত সিলমোহর দেবে তারাই।’’
এমসিআইয়ের ত্রুটি-গাফিলতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে সর্বোচ্চ আদালত। তারা মনে করে:
• দেশের মেডিক্যাল শিক্ষার মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব পালনে এমসিআই সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
• মেডিক্যাল পঠনপাঠনেও কোনও দিশা দেখাতে পারেনি তারা।
• মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ভর্তির ক্ষেত্রে দুর্নীতিও রুখতে পারছে না এমসিআই।
শিক্ষার মানের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট কোনও আপস করতে রাজি নয়। তাই এক রকম বাধ্য হয়েই সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে তাদের এই নজরদার কমিটি তৈরি করতে হয়েছে বলে জানিয়ে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। রাজ্য মেডিক্যাল জয়েন্ট তুলে দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য সারা দেশে একটিই অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা নিতে হবে বলে সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এবং তার মূলেও আছে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ভর্তি নিয়ে ওঠা ভূরি ভূরি দুর্নীতির অভিযোগ।
সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তে ঝড় উঠেছে দেশের চিকিৎসক মহলে। দেশের মেডিক্যাল শিক্ষা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ আদালত তাদের রায়ে যে-ভাবে তুলোধোনা করেছে, সেটা সময়োপযোগী বলেই মনে করছেন চিকিৎসক মহলের একটি বড় অংশ। সংসদের স্বাস্থ্য বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে এমসিআই-কে অস্বচ্ছ এবং কার্যত অক্ষম বলেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। গত মার্চে রিপোর্টটি সংসদে পেশ করা হয়। তার পরেও কেন্দ্রীয় সরকার সেই বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। বিচারপতি অনিল আর দাভের নেতৃত্বাধীন সাংবিধানিক বেঞ্চ সোমবার তাদের রায়ে বলেছে, ‘‘সংসদীয় কমিটির ওই রিপোর্ট আমাদের নাড়িয়ে দিয়েছে। গোটা দেশের মেডিক্যাল শিক্ষা বড়সড় বিপর্যয়ের মুখে। দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এ-সব বন্ধ করার জন্য কিছু একটা করা দরকার বলে মনে করছি আমরা। তাই সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিন সদস্যের নজরদার কমিটি বসানো হচ্ছে।’’
শুধু ডাক্তারি শিক্ষার শোচনীয় অবস্থা নয়, কর্মরত ডাক্তারদের একটি অংশের লুটে খাওয়া মনোভাবেরও তীব্র নিন্দা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। ১৬৪ পাতার ওই রায়ের এক জায়গায় তারা বলেছে, যাঁরা ডাক্তারি পাঠ্যক্রম পাশ করে বেরোচ্ছেন, তাঁদের একটি বড় অংশ নানা ধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। অপ্রয়োজনে নানা ধরনের দামি পরীক্ষানিরীক্ষা করাতে বলেন তাঁরা। অপ্রয়োজনে লেখেন নানা ওষুধ। এমনকী অকারণ অস্ত্রোপচার করে গরিব রোগীদের কাছ থেকে যথেচ্ছ টাকা আদায় করেন। ‘এখনই এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের এই ব্যবস্থা নিতে হল,’ রায়ে জানিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
ডাক্তারদের জ্ঞানের ঘাটতির উল্লেখ করে রোগীদের অসহায়তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে শীর্ষ আদালত। চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে চিকিৎসকদের একাংশের প্রাথমিক জ্ঞানটুকুও নেই বলে মন্তব্য করেছে সর্বোচ্চ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ। তাদের রায়ের একটি অংশে বলা হয়েছে, ‘‘মেডিক্যাল কলেজ থেকে যাঁরা পাশ করে বেরোচ্ছেন, তাঁদের অনেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয়গুলিও জানেন না। স্বল্প পরিকাঠামোয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো জায়গায় কী ভাবে পরিষেবা দেওয়া যায়, সেই বিষয়েও তাঁদের অনেকেই অন্ধকারে।’’
এই সব অন্ধকার দূর করার ভার যাদের উপরে ন্যস্ত, সেই এমসিআই-কে দুরমুশ করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। তাদের পর্যবেক্ষণ, ‘‘সব জেনেও এই শোচনীয় পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য এমসিআইয়ের তরফে কোনও চেষ্টাই দেখা যায়নি। নজরদার কমিটি সেই জন্যই।’’
সর্বোচ্চ আদালতের এই পর্যবেক্ষণ এবং নজরদার কমিটি গড়ে দেওয়ার ব্যাপারে কী বলছেন চিকিৎসকেরা?
এমসিআইয়ের দুর্নীতি নিয়ে যিনি একাধিক মামলা করেছেন, সেই প্রবাসী চিকিৎসক কুণাল সাহা জানান, এমসিআইয়ের এক সভাপতি একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের কাছ থেকে ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত চলছে। ‘‘এমসিআই কিন্তু এখনও তাঁর সঙ্গ ছাড়তে পারেনি। তাঁর রেজিস্ট্রেশনও বাতিল করা হয়নি। এই ভাবে এমসিআই দুর্নীতিকেই প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। এর মোকাবিলায় আগেই সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল,’’ বলছেন কুণালবাবু।
সর্বোচ্চ আদালতের গড়ে দেওয়া কমিটিকে সাহায্য করতে তারা তৈরি বলে জানিয়েছে চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (আইএমএ)। ‘‘আমি নিজে আগে এমসিআইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ওই প্রতিষ্ঠানকে ফের সক্রিয় করে তোলা কতটা সম্ভব জানি না। তবে সর্বোচ্চ আদালতের গড়ে দেওয়া কমিটির সঙ্গে আমরা সংগঠনগত ভাবে সব রকম সহযোগিতা করব। দেশের মেডিক্যাল শিক্ষার স্বার্থে আমাদের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে,’’ বলেন আইএমএ-র সেক্রেটারি জেনারেল কৃষ্ণকুমার অগ্রবাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy