চার কন্যা: প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কণিকা, প্রিয়া, পিউ ও শিলা (বাঁ দিক থেকে)। নিজস্ব চিত্র
স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল। ঠিক মতো কথাও বলতে পারেন না। রয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ মানসিক প্রতিবন্ধকতা। অভাবের পরিবারে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়ে তারাই পেরিয়েছেন মাধ্যমিকের গণ্ডি। পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলী ২ ব্লকের শ্যামবাটী রাধাকৃষ্ণ ভৌমিক বিদ্যাপীঠের চার ছাত্রী বড় পরীক্ষায় সফল হয়েছেন প্রথম বারের চেষ্টাতেই।
ওই চার জনের মধ্যে বছর একুশের শিলা ভৌমিক, বছর আঠারোর প্রিয়া ভৌমিক ও ষোলো বছরের পিউ ভৌমিক সহোদর বোন। তাদের সঙ্গেই পাশ করেছেন বছর তেইশের কণিকা দেবনাথ। শিলা ২৬৮, প্রিয়া ২৭৯, পিউ ২৫৯ ও কণিকা ২৫৫ নম্বর পেয়েছেন। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অমিতাভ দাঁ বলেন, ‘‘এই ধরনের রোগীদের স্মৃতিশক্তি কম থাকে। শারীরিক নানা সমস্যাও থাকে। করোনা-কালে পড়াশোনাও ব্যাহত হয়েছে। তা সত্ত্বেও ওই চার ছাত্রী মাধ্যমিকে সফল হয়ে অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রমাণ দিয়েছেন।’’
ওই ছাত্রীদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক শুভঙ্কর কর বলেন, ‘‘নম্বর নজরকাড়া না হলেও, ওদের মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করানোটাই আমাদের
কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রথম দিকে ওরা ক্লাসঘর থেকে পালাত। ভালবেসে ক্লাসে ফেরানো হত। পড়া মনে রাখতে পারত না। সে জন্য শিক্ষকেরা ওদের আলাদা ভাবে গুরুত্ব দিয়ে পড়াতেন।’’ তিনি জানান, ওই ছাত্রীদের মায়েরা শিক্ষকদের কাছে পড়া বুঝে নিয়ে বাড়িতে নিজেরা পড়াতেন। করোনা-কালেও মায়েরা নিয়মিত শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। ‘রাইটার’ দিয়ে চার জনের পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রধান শিক্ষকের কথায়, ‘‘পড়ুয়া, শিক্ষক ও বাবা-মায়েদের যৌথ লড়াইয়ে
এই সাফল্য।’’
পূর্বস্থলীর বৈদ্যপুরে টিনের চালার ইটের গাঁথনি দেওয়া এক কামরার বাড়িতে শিলা, প্রিয়া ও পিউদের বাস। বাবা নারায়ণ ভৌমিক টোটো চালান। তিনি বলেন, ‘‘পাঁচ মেয়ের মধ্যে প্রথম দু’জনকে অভাবের কারণে বেশি দূর পড়াতে পারিনি। বাকি তিন মেয়ে জন্ম থেকে মানসিক প্রতিবন্ধী। বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা করিয়েও লাভ হয়নি। তাই ওদের পড়ানোর কথা ভাবতেও পারিনি।’’ তিনি জানান, তিন মেয়ে যখন-তখন বাড়ি থেকে পালাতেন। তাই স্কুলের ঘেরাটোপে রাখতে এক সঙ্গে তিন জনকে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করেন। তিনি বলেন, ‘‘কোনও দিন ভাবিনি, ওরা মাধ্যমিক পাশ করবে!’’
তেলিনপাড়ার কণিকাদেরও দিন আনা, দিন খাওয়া পরিবার। বাবা কমল দেবনাথের তেলেভাজার দোকান। দুই মেয়ের মধ্যে কণিকা ছোট। তিনি বলেন, ‘‘ছোট থেকেই কণিকার স্মৃতিশক্তি খুব দুর্বল। চঞ্চল স্বভাবের মেয়েটা অন্য শিশুদের সাহচর্যে থেকে যদি কিছুটা স্বাভাবিক হয়, সে আশাতেই ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম।’’
সংসারের হেঁশেল সামলে মেয়েদের নিয়মিত স্কুলে আনা-নেওয়া, সকাল-সন্ধ্যা বাড়িতে পড়া দেখানোর পরে এমন সাফল্যে দুই মায়ের মুখেও তৃপ্তির হাসি। শিলা, প্রিয়াদের মা নীলিমা ভৌমিক ও কণিকার মা মনিকা দেবনাথের মন তবু বিষন্ন। তাঁরা বলেন, ‘‘মেয়েরা আরও পড়তে চায়। কিন্তু সে খরচ আসবে কোথা থেকে? সেটাই এখন চিন্তার।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy