পাভলভ মানসিক হাসপাতাল। —ফাইল চিত্র।
দেড় বছরের কোলের বাচ্চা শিয়ালদহ স্টেশনে হারিয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়লে এখনও ফুঁপিয়ে কাঁদেন ঢাকার মুক্তা আখতার। মানসিক হাসপাতালের ঘেরাটোপে চার বছর কেটে গেলেও সে ক্ষতে এখনও রক্ত ঝরে। দশ বছর কলকাতার পাভলভে ‘বন্দি’ সাদিকুল ইসলাম গুলিয়েই ফেলেছেন কবে, কী ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে ঢুকেছিলেন। স্বামীহারা মুক্তার দাবি, পেটের জ্বালায় কাজের খোঁজে ‘ইন্ডিয়া’ এসে কোলের বাচ্চা-সহ সব খুইয়ে বসেন। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে পাভলভে পাঠানো হয়। দিনাজপুরের বাসিন্দা সাদিকুলেরও বারাসতের আদালত মারফত পাভলভে ঠাঁই হয়েছে। কিশোরগঞ্জের মেয়ে সুমি খাতুনও বরের উপরে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলেন। বছর খানেক হল পাভলভে রয়েছেন তিনি।
পাভলভের এই তিন বাংলাদেশি আবাসিক পুরোপুরি সুস্থ হলেও দুই দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এখনও মানসিক হাসপাতালে পড়ে। পাভলভ, লুম্বিনী, বহরমপুর ও পুরুলিয়ার মানসিক হাসপাতাল মিলিয়ে এমন ১৮ জন বাংলাদেশি সুস্থ দশায় হাসপাতালেই রয়েছেন বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। পাভলভের চার জন বাংলাদেশি আবাসিকের এ বার দেশে ফেরার বাধা দূর হয়েছে। আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁদের পেট্রাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ও-পার বাংলার মাটি ছোঁয়ার কথা। বাংলাদেশ সরকারের তরফে ইতিমধ্যেই ওই চার জনের ফেরার ছাড়পত্র প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ওই চার জনকে সহযোগিতা করার কথা বলা হয়েছে। পাভলভ হাসপাতালের সুপার মাসুদ হাসান আলির কথায়, ‘‘হাসপাতালের বাংলাদেশি আবাসিকেরা পুরোপুরি সুস্থ। বাড়িতে অল্পবিস্তর ওষুধ খেয়েই তাঁরা ভাল থাকবেন।’’ রাজ্যের শিশু ও নারী পাচার সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের উপদেষ্টা মধুমিতা হালদার বলছেন, ‘‘বাংলাদেশি আবাসিকদের দেশে ফেরার জন্য এ দেশে পুলিশের অনুমতি লাগে। স্বরাষ্ট্র দফতর ও বিদেশ দফতরকেও জানাতে হয়। এর পরে ঢাকার সায় জরুরি।’’
ফেরার জন্য এখন তর সইছে না পাভলভের আবাসিক আবিদ হোসেন, সুমাইয়া খাতুন, পারভিন ওরফে পায়েল এবং এরশাদ শেখের। নারায়ণগঞ্জের আবিদ দুই বাংলায় পুরস্কারজয়ী কবি। পাসপোর্ট হারিয়ে এবং কিছু ভুল বোঝাবুঝির ফলেই তাঁর দুর্গতি। এখন ফেরার প্রাক্কালে তিনি হাসপাতালের আধিকারিকদের বার বার বলছেন, ‘‘আমি সুস্থ এটা দয়া করে লিখে দেবেন। দেশে ফিরেই আমার মায়ের চুরি যাওয়া সোনার গয়নার জন মামলা লড়তে হবে। কেন কোর্টে হাজিরা দিতে পারিনি, আদালতকে বোঝাতে হবে তো!’’ সাতক্ষীরার পরভিনের মা ধান্যকুড়িতে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। মায়ের সঙ্গে এ দেশে আসেন তিনি। জনৈক কাশ্মীরি যুবকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় দশ বছর আগে। ‘‘মিষ্টির দোকানে বসায়ে রেখে আমার বর চলে গেছে’’, যন্ত্রণার কাহিনি শোনান তিনি। এর পরে পুলিস পাভলভে রাখে পরভিনকে। তিনি বলেন, ‘‘মায়ের একটা পা নেই। তবু আমারে দেখতে আসে। আমারে ছাড়াতে পারে না বলে কাঁদে।’’ বাগেরহাটের সুমাইয়া খাতুনও দু’বছর আগে দুর্গাপুরে জনৈক আত্মীয়ের কাছে এসে বিপাকে পড়েন। মাগুরার এরশাদ হোসেনেরও স্মৃতি ঝাপসা। কবে, কী ভাবে এ দেশে এসেছেন মনেও নেই। তবে দেশে ফিরে বহু দিন অনাস্বাদিত শুঁটকির ভর্তা স্বাদের জন্য তাঁরও ভিতরটা হাঁকপাক করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy