শেষ দেখা: চাদর সরিয়ে মৃত দিদি অপর্ণা সরকারের মুখ দেখছেন চন্দনা মণ্ডল। শুক্রবার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: সুমন বল্লভ
হাজার হাজার মানুষের ভিড় তখন ঢোকার চেষ্টা করছে মন্দির চত্বরে। কারও হাতে জলের পাত্র। কারও কাঁধের বাঁকে ঝোলানো কলসি। উল্টো দিক থেকে বহু লোক বেরিয়ে আসছেন মন্দির থেকে।
বৃহস্পতিবার রাত ২টো। সবে ধরেছে বৃষ্টি। জন্মাষ্টমীর ক্ষণ পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে মন্দিরে ঢোকার জন্য হুড়োহুড়ি বেশি। অথচ ১৫০ মিটার লম্বা এবং ১০ হাত চওড়া যে পথে ভিড় এগোচ্ছে, তার এক পাশে পুকুর। অন্য পাশে পাঁচিল। ভিড়ের একটা অংশ ঢুকে পড়েছিল পুকুরের উপরে বাঁশ পুঁতে কাঠের তক্তা ফেলে তৈরি অস্থায়ী দোকানগুলিতে। এর পরেই বিপত্তি।
হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল গোটা পনেরো দোকান। জলে-কাদায় পড়লেন অনেকে। শুরু হয়ে গেল ছোটাছুটি, আর্তনাদ। ভিড়ের চাপে ভাঙল রাস্তার ধারের পাঁচিল। যাঁরা পড়লেন মাটিতে, তাঁদের মাড়িয়ে সবাই তখন নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত।
বৃহস্পতিবার উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের কচুয়ায় লোকনাথ মন্দিরে পুজো দিতে এসে এ ভাবেই পদপিষ্ট হয়ে প্রাণ গেল বেশ কয়েক জনের। সরকারি মতে সংখ্যাটা পাঁচ বলা হলেও রাত পর্যন্ত প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে । জখম শতাধিক। ১৫ জন হাসপাতালে ভর্তি। শুক্রবার মন্দির-সংলগ্ন এক দোকানের মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায় এক কিশোর।
২০১৫ সালের অগস্টে দেওঘরেও শিবের মাথায় জল ঢালতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ১০ জনের। সেই ঘটনায় প্রশাসনিক গাফিলতির অভিযোগ উঠেছিল।
আরও পড়ুন: ‘আমার হাতটা আর নেই গো’
কচুয়ার ঘটনায় দায় কার? শুরু হয়েছে চাপান-উতোর। তবে শুক্রবার রাত পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে কোনও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। বরং দুর্ঘটনার পরও দিনভর ভক্তদের যাতায়াত চলেছে মন্দিরে।
বিপর্যয়ের বৃহস্পতিবার
বিকেল ৪টে: শুরু হল বৃষ্টি।
রাত ১১টা: বৃষ্টি কমতে বেরিয়ে পড়লেন ভক্তরা।
রাত দেড়টা: মন্দিরের সামনে হাজার মানুষের ভিড়। বাইরে লক্ষ মানুষ।
রাত ১টা ৪০: ভিড়ের চাপে ভাঙল তোরণ, পুলিশের ব্যারিকেড।
রাত ২টো: ভেঙে পড়ল পাঁচিল, ১৫টি দোকান।
রাত আড়াইটে: অ্যাম্বুল্যান্স এল। আহতদের নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে।
মৃতের তালিকা
পূর্ণিমা গড়াই (৪৭), রাজারহাট
তরুণ মণ্ডল(২৭),হাসনাবাদ
অপর্ণা সরকার (২৭),স্বরূপনগর
সনকা দাস(৬৬),হাসনাবাদ)
অজ্ঞাতপরিচয় (৫৫),পুরুষ
জখম শতাধিক।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আহত ও মৃতদের পরিবারের খবর নিতে শুক্রবার গিয়েছিলেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও এসএসকেএমে। মৃতদের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেন তিনি। আহতদের দেওয়া হবে ১ লক্ষ টাকা করে। কম আহত যাঁরা, তাঁরা পাবেন মাথা-পিছু ৫০ হাজার টাকা।
কিন্তু এমন ঘটল কেন? স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার কারণ মূলত দু’টি। (১) রাত ২টোর সময় সরু ওই রাস্তায় এক সঙ্গে হাজার হাজার লোক ঢুকে পড়া। (২) পুকুরের উপর অপরিকল্পিত ভাবে তক্তা ফেলে নড়বড়ে দোকান তৈরি।
আর এখানেই উঠছে গাফিলতির প্রশ্ন। কারণ, সরু রাস্তায় লোক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাখা হয়নি পর্যাপ্ত পুলিশ। যে ক’জন ছিলেন, বৃষ্টিতে তাঁরাও ছিলেন ছন্নছাড়া। মন্দির থেকে লোক বার হওয়ায় জন্য পৃথক রাস্তা করা হয়নি। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ এক সঙ্গে ঢুকতে এবং বার হতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে যায়। এর মধ্যে কিছু লোক গিয়ে আশ্রয় নেন দোকানে। সেই ভার সহ্য করার মতো ক্ষমতা ছিল না নড়বড়ে দোকানের। তা ভেঙে পড়ে পুকুরে। কেন ভিড় নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত পরিকল্পনা করা হয়নি, কে এ ভাবে পুকুরের উপরে দোকান তৈরির অনুমতি দিয়েছিল? তা নিয়ে চাপান-উতোরের মধ্যে মিলছে না স্পষ্ট জবাব।
যেমন, মুখ্যমন্ত্রী শুক্রবার বলেন, ‘‘ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। খুব বেশি ভিড় হওয়ায় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য এই ঘটনা ঘটেছে। কচুয়ায় আগে কখনও এমন ঘটেনি। মন্দিরের সামনে কয়েক জন বাঁশ লাগিয়ে, ত্রিপল টাঙিয়ে বসেছেন। বললেই অশান্তি। বললেও শুনবে না। এক দিকে পুকুর, অন্য দিকে সরু রাস্তা। কার্যত পুকুরের উপরেই দোকান বসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে কেউ কেউ সেখানে আশ্রয় নিতে গিয়েছিলেন। হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। পাশেই পুকুর ছিল। অনেকে পুকুরে পড়ে যান। পাঁচিল ভেঙে যায়।’’
খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ঘটনার পরে গিয়েছিলেন কচুয়ায়। তিনি বলেন, ‘‘বৃষ্টির পরে তাড়াহুড়ো করে ঢুকতে গিয়েই বিপত্তি। এ জন্য লোকনাথ মিশন ট্রাস্ট কমিটিই দায়ী। এটি স্বশাসিত সংস্থা। এরা প্রশাসনের
নিয়ম মানেনি।’’ তাঁর দাবি, প্রশাসনের পরামর্শ ছিল, লোকেদের ঢোকা ও বের হওয়ার রাস্তার মাঝখানে ব্যারিকেড করা হোক। কিন্তু তা মানেনি মন্দির কমিটি।
মন্দির কমিটির সম্পাদক তুষার বসাকের অবশ্য দাবি, ‘‘মন্দিরের ভিতরের দায়িত্বে আমরা ছিলাম। বাইরে কী হচ্ছে, কারা বসছে— সে সব প্রশাসনের দেখার কথা। এ নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের বেশ কয়েক বার বৈঠকও হয়েছে।’’ লোকনাথ মিশনের সভাপতি বিষ্ণুপদ রায়চৌধুরী আবার বলেন, ‘‘মন্দিরের ভিতরে আমরা ৬০০ স্বেচ্ছাসেবক রেখেছিলাম।’’
কিন্তু মেলা কমিটি প্রশাসনের অনুমতি নিয়েছিল কি? এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক চৈতালি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কমিটির সঙ্গে প্রশাসনিক কর্তাদের বৈঠক হয়েছিল। অনুমতি কী ছিল, তা দেখা হচ্ছে।’’ কিন্তু বৈঠকই যদি হয়ে থাকে, তা হলে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা, গার্ডওয়াল ছাড়া পুকুরের মধ্যে তক্তা ফেলে দোকান তৈরির মতো বিষয়গুলি প্রশাসন দেখল না কেন? অস্থায়ী দোকানের অনুমতি কে দিল? জেলা শাসক বলেন, ‘‘কী করে ঘটনাটি ঘটল, তা দেখা হচ্ছে। মেলা কমিটি কী ব্যবস্থা নিয়েছিল, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে।’’
আর ভিড় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পুলিশের দিকে ওঠা অভিযোগের ব্যাপারে রাজ্য পুলিশের ডিজি বীরেন্দ্র বলেন, ‘‘পুলিশ কী করেছে, তা দেখা হবে। এ ক্ষেত্রে কার কতটা গাফিলতি রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। গাফিলতি হলে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ কিন্তু সেই গাফিলতির দায় কার, কবেই বা তা নির্দিষ্ট করা হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট উত্তর মেলেনি দিনের শেষে। ফলে শেষমেশ সব দায় গিয়ে পড়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং পুণ্যার্থীদের ঠেলাঠেলির উপরে! আর গত দু’দিন ধরে পথে যা চোখে পড়েনি, দুর্ঘটনার পর শুক্রবার রাতে তা দেখা গিয়েছে—কচুয়া-স্পেশাল সরকারি বাস! তবে তা ছিল ফাঁকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy