ছবি: সংগৃহীত
এবড়োখেবড়ো হয়ে যাওয়া দরমার গায়ে আটকানো একটা পেরেক। মাথার দিকটা ঈষৎ বাঁকা। সম্ভবত ভারী কিছু দিয়ে অপটু হাতে ঠোকার চিহ্ন বহন করছে। সেই পেরেক থেকে ঝুলছে চৌকো আকৃতির সস্তার একটা আয়না। ১৫ মিনিট ধরে তার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে ঝিমলি। মেয়ের দেরি দেখে এক সময় তাড়া দেয় সবিতা— ‘কীরে হল তোর! কখন যাবি? অঞ্জলি তো শুরু হয়ে যাবে।’’
মা’র কথার জবাব দেয় না ঝিমলি। পাউডারে ডোবানো পাফটা গালে-মুখে আরেকবার বুলিয়ে মুখটাকে আয়নার কাছে নিয়ে যায় সে। মন খারাপ হয়ে যায় তার। মনে মনে ভগবানের ওপর রাগ হয় তার— ‘ঠাকুর, একজনকে এতটা কালো বানাতে তোমার একটু কষ্ট হল না!’ দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ফের হলুদরঙা শাড়ির আঁচলটা ঠিক করতে শুরু করে সে। হাত বেঁকিয়ে চুলের গোছাটা পিছনে নিয়ে গিয়ে প্রথমে ক্লিপ আটকায়। তারপর কপালের ওপর এসে পড়া চুলগুলোকে কানের পাশ দিয়ে সরিয়ে নিয়ে দ্রুত রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।
বহরমপুরের মহারানি কাশীশ্বরী গার্লস স্কুলে ইলেভেনে পড়ে ঝিমলি। গত বার এই স্কুল থেকে মাধ্যমিকে পাঁচটা লেটার নিয়ে পাশ করেছে। ছোট থেকেই বরাবর ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে এসেছে সে। স্বভাবেও ভারী মিষ্টি। মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন সবিতার। পাশের বাড়ির নমিতা কাকিমা সেদিন সবিতাকে বলছিলেন, ‘‘তুমি পুণ্যবতী যে, এমন মেয়ে পেয়েছ। নইলে আজকের দিনে এমন রূপে সরস্বতী, গুণে লক্ষ্মী মেয়ে পাওয়া চাট্টিখানি কথা!’
স্নেহের বশে নমিতা কাকিমা যে একটু বাড়িয়ে বলেছেন, বুঝতে অসুবিধে হয়নি ঝিমলির। সুন্দরী তো দূর, নিজেকে সে সুশ্রী বলেও ভাবে না। রোগাসোগা, কালো চেহারা। সে দেখেছে, রাস্তাঘাটে তার দিকে ছেলেরা ফিরেও তাকায় না। নিজেকে সব সময় গুটিয়ে রাখতে ভালবাসে সে। সচরাচর কারও বাড়িও যায় না। কিন্তু আজ এক মহা ফ্যাসাদে পড়েছে সে। প্রাণের বন্ধু সুমনার আব্দার, ওদের বাড়িতে সরস্বতী পুজো। দু’জনে একসঙ্গে সেখানে অঞ্জলি দেবে। সক্কাল সক্কাল চান করে তাই বেরিয়ে পড়তে হয়েছে তাকে।
স্বর্ণময়ী বাজারে কাছে সুমনাদের বাড়ির সামনেটা পৌঁছতে ঝিমলি দেখল, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সুমনা। তাকে দেখে ঝাঁঝিয়ে ওঠে— ‘কী রে, এত দেরি করলি যে!’ সে কিছু বলতে যাচ্ছিল। সুমনা তার হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়। অঞ্জলি শেষ হলে ঘরের এক কোণে সোফায় বসল ঝিমলি। এর আগেও একবার সে সুমনাদের বাড়িতে এসেছে। ফলে সুমনার বাড়ির লোকদের ও চেনে। তবে আজ হলুদ পাঞ্জাবি পরা, ২৩-২৪ বছরের একটা ছেলেকে ঘোরাঘুরি করতে দেখল ও। ঝিমলি মনে মনে ভাবল, এ-ই কি তবে সুমনার দাদা সুগত। বন্ধুর মুখে এর কথা তো অনেক শুনেছে সে— সুগত খুব মেধাবী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলি কমিউনিকেশন নিয়ে পড়ে— আরও কত কী!
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সুমনা ওকে ছাদে নিয়ে গেল। ঝিমলি দেখে, সেখানে আগে থেকেই রয়েছে সুগত। দাদার সঙ্গে বন্ধুর আলাপ করিয়ে দেয় সুমনা। তারপর এক সময় ওরা তিন জন গল্পে মেতে ওঠে। ঝিমলিকে লজ্জা পেতে দেখে কথাবার্তা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সুগতই। উচ্চমাধ্যমিকের পর ঝিমলি কী পড়তে চায়, ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি তার কেমন লাগে, রেফারেন্স বই কার পড়ে— সুগতর এমন হাজারো প্রশ্নের ধৈর্য ধরে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল ঝিমলি।
সুগত দারুণ সপ্রতিভ। কথাবার্তা যত এগোচ্ছিল, ততই তার প্রতি একটা টান অনুভব করছিল ঝিমলি। ক্রমে সে বুঝতে পারে, সুগতর সান্নিধ্য তার ভাল লাগছে। ফিলিংসটাকে অবশ্য আপ্রাণ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করল ও। গল্পগুজবে সন্ধ্যা নামে।
সুমনার দিকে অপাঙ্গে তাকায় ঝিমলি। মানেটা— এ বার আমায় ফিরতে হবে। বাড়ি ফেরার সময় স্বর্ণময়ী বাজার পর্যন্ত ঝিমলিকে এগিয়ে দিল সুগত। এত সুন্দর একটা দিন হুশ করে শেষ হয়ে যাওয়ায় মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল ঝিমলির। বাড়ি ফিরেই সেটা কাটল না। অন্য দিনের চেয়ে আজ একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়ল ও।
পরদিন ঘুম ভাঙল সুমনার ফোনে। জড়ানো গলায় ঝিমলি ‘হ্যালো’ বলতেই ও প্রান্ত থেকে সুমনা বলে ওঠে— ‘‘কী ম্যাডাম, ঘুম ভাঙল!’’ ঝিমলি মুচকি হাসে। সুমনা বলে চলে—‘‘কাল বাড়ির সবাই তোর আচার-ব্যবহারের প্রশংসা করছিল। সায়েন্সে তোর ফান্ডা দেখে দাদা তো অবাক। দাদা বলল, চেষ্টা করলেই তুই জয়েন্টে প্রথম দিকে র্যাঙ্ক করবি।’’
সুমনা এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে চলেছিল। সব কথা ঝিমলির কানে ঢুকছিলও না। অদ্ভুত একটা ভাললাগা ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। ফোন ধরে চুপ করে বসে থাকে ঝিমলি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy