স্মার্টফোন নেই। দুই ছেলের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে হয়েছে বাউল বিকাশ দলুইকে। বোলপুরে। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
স্মার্ট ফোন চাই, পড়াশোনার জন্য। কার বাড়িতে মিলবে সেই সাত রাজার ধন? পড়ুয়াদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে শুরু করলেন বিমলেন্দু সিংহরায়। কিন্তু নাগেশ্বরী চা বাগানের গ্রাম। এখানে স্কুলছুট বাচ্চা মিলতে পারে। কিন্তু স্মার্ট ফোন...! বিমলেন্দু হাল ছাড়লেন না। টানা চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত খোঁজ পেলেন, একটা-দুটো নয়, সাত সাতটি স্মার্ট ফোনের। কিন্তু পেলে কী হবে, সাতটির মধ্যে পাঁচটির মালিক ফোন রিচার্জই করাননি। বাকি দু’টি সজীব আছে ঠিকই, কিন্তু মালিক শুধু ভিডিয়ো দেখেন। বিমলেন্দুর কথা শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে তাঁদেরই এক জন জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘মোবাইলে আবার পড়াশোনা হয় নাকি?’’
জলপাইগুড়ির মেটেলিতে অচল এই চা বাগানে তাই স্মার্ট ফোনে পড়ানোর নামই আর করেননি বাগানের টিজি লাইন প্রাথমিক স্কুলের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিমলেন্দু।
কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বোলপুরের বিকাশ দলুইয়ের কাছেও শোনা গেল একই কথা। বিকাশ বাউল, গান গেয়েই রোজগার। বড় ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে, ছোট জন দ্বিতীয়তে। দু’জনই আদিত্যপুর নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ের ছাত্র। বিকাশ বলছিলেন, ‘‘অনলাইনে পড়া-টড়া হয়নি এখানে। আর হলেই বা কী করতাম? স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট নেওয়ার মতো ট্যাঁকের জোর আছে নাকি আমাদের?’’
হিমাচলপ্রদেশের কুলদীপ কুমারের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিলেন বোলপুরের বিকাশ। কুলদীপেরও দুই সন্তান। এক জন পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে, অন্য জন দ্বিতীয়তে। স্কুল থেকে অনলাইন ক্লাসের জন্য চাই স্মার্ট ফোন। দোকানে খোঁজ করে দেখেছিলেন কুলদীপ, ছ’হাজার টাকা দাম। কিন্তু সামর্থ্য কোথায়! এ দোর ও দোর ঘুরে যখন কিছুই জুটল না, স্মার্ট ফোন কিনতে তখন তিনি পোষা গরুটিকে বেচে দিলেন!
বিকাশের অবশ্য বেচার মতো গরুও নেই।
এই যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে রাজ্য জুড়ে টানা লকডাউনের মধ্যে ক্লাস হবে কী করে? অথচ ক্লাস বন্ধ থাকলে প্রাথমিকের বাচ্চাদের স্কুলে টেনে রাখাই কঠিন। স্কুলছুটের প্রবণতা এই সময় থেকেই বাড়ে। শিক্ষা দফতরেরই এক কর্তা বলছেন, ‘‘মিড ডে মিলের ব্যবস্থা না হয় হল। কিন্তু পড়াশোনার কী হবে? তাই প্রথমে অনলাইন ক্লাসের কথা ভাবা হয়েছিল।’’ এই বাচ্চাদের অনেকেই প্রথম প্রজন্ম লেখাপড়া করছে, জানালেন পশ্চিম বর্ধমানের এক প্রধান শিক্ষক। তাঁর কথায়, ‘‘ক্লাস চালু না থাকলে এরা লেখাপড়ায় অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে।’’
কিন্তু ক্লাস হবে কী ভাবে? জলপাইগুড়ির নাগেশ্বরী চা বাগানই হোক বা বোলপুরে বাউলের ঘর, এ ক্ষেত্রে জবাব একটাই— সে সুযোগ নেই। অনেক স্কুলের প্রধান শিক্ষকই বলছেন, বহু জায়গায় দূরদূরান্ত থেকে পড়ুয়ারা আসে। অনেকেরই ফোন নম্বর নেই। যে সব ফোন নম্বর দেওয়া আছে, তার মধ্যে অনেকগুলিরই আবার অস্তিত্ব নেই। ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় দেখা যাচ্ছে, প্রথম প্রজন্মের শিশুদের বাবা-মায়েদের খাবার জোগাড়ের চিন্তায় মাথা খারাপ। বাচ্চাদের হাতে স্মার্ট ফোন এনে দেবেন কোথা থেকে! কী ভাবেই বা মুখে মুখে বোঝাবেন পড়া!
বাঁকুড়া জেলা স্কুল শিক্ষা পরিদর্শক (প্রাথমিক) জগবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘লকডাউনের শুরুর দিকে মেজিয়া, খাতড়ার মতো কয়েকটি সার্কলে কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানিয়ে ই-লার্নিং চালাতে চেয়েছিল। তবে অধিকাংশ অভিভাবকেরই স্মার্ট ফোন না থাকায় সমস্যা হয়। উদ্যোগও সফল হয়নি।’’
পরিস্থিতির বিচার করে বাংলা শিক্ষা পোর্টাল থেকে পাঠ্যবস্তু (অ্যাক্টিভিটি টাস্ক) ডাউনলোড করে, তার প্রতিলিপি তৈরি করে, সে টাস্ক পড়ুয়াদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় প্রাথমিক স্কুলগুলিকে। ঠিক হয়, মিড ডে মিলের চাল, আলু নিতে এলে অভিভাবকদের হাতে দেওয়া হবে সেই টাস্ক। সেটাও যে সব ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে, তা নয়। দুর্গাপুরের বিজড়া প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনির্বাণ বাগচি বলেন, ‘‘সবার হাতে ওই টাস্ক তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরের বার মিড ডে মিল দেওয়ার সময়ে বাকিদের হাতে দিয়ে দেওয়া হবে।’’ ফোনে যোগাযোগ করতে পারছেন না, কারণ সব নম্বর ‘চালু’ নেই।
এই পরিস্থিতিতে স্কুলশিক্ষা দফতর ফোনে পড়াশোনা শুরু করার কথা জানিয়েছে। শীঘ্রই তা শুরু হবে। তবে তা নিয়েও সংশয় থেকে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রাথমিক স্তরে সব অভিভাবকের কাছে সাধারণ মোবাইল ফোনটাও আছে তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy