Advertisement
২০ ডিসেম্বর ২০২৪
Firhad Hakim Controversy

অতীতেও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য করেছেন ববি, এ বার ফাঁপরে ফেলল বাংলাদেশ

গত জুলাই মাসে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ববি যা বলেছিলেন, তার নির্যাস এই যে, যাঁরা ইসলাম নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি, তাঁরা ‘দুর্ভাগা’। কিন্তু তৃণমূল তখন সেই কথার আনুষ্ঠানিক ভাবে নিন্দা করেনি।

Firhad Hakim had made controversial comments in the past, this time he had to listen to the party\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\\'s criticism for Bangladesh

বৃহস্পতিবার অ্যালেন পার্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। —ফাইল ছবি।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৮
Share: Save:

ফিরহাদ হাকিম কি এই প্রথম সংখ্যালঘু প্রসঙ্গে ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য করলেন? না। বরং তাঁর দলের অনেকে মনে করেন, তাঁর আগের মন্তব্য ছিল ‘উগ্র সাম্প্রদায়িক’।

কিন্তু সেই মন্তব্যের কারণে কি তাঁর দল তাঁর আনুষ্ঠানিক ভাবে নিন্দা করেছিল? না। তা হলে এ বার কেন?

কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদের (ববি) যে মন্তব্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাকে ‘নস্যাৎ’ করে অনুষ্ঠানিক ভাবে তার নিন্দা করতে হয়েছে তৃণমূলকে। দলের প্রথম সারির নেতারা একান্ত আলোচনায় গোপন করছেন না যে, সর্বময় নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওই মন্তব্যের কারণে ববির উপর ‘রুষ্ট’। কেন?

উত্তর একটাই— বাংলাদেশ। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে এ পার বাংলায় উদ্বেগ, যাতে খানিকটা ইন্ধন দিচ্ছে প্রচারমাধ্যমের একাংশের ভূমিকাও। পোড়খাওয়া রাজনীতিক মমতা জানেন, পড়শি দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের যে বিবরণ প্রকাশ্যে আসছে, তার আঁচ কাঁটাতারের এ পারেও রয়েছে। ও পারের সেই আগুনের আঁচে নিজেদের ‘রাজনৈতিক রুটি’ সেঁকতে চাইছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর একাধিক কর্মসূচি এবং বক্তৃতা তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটেই ফিরহাদের বক্তৃতার নিন্দা করতে তৃণমূল এক প্রকার ‘বাধ্য’ হয়েছে। ফলে অতীতে পার পেয়ে গেলেও এ বার ফিরহাদের মন্তব্যে নীরব থাকতে পারেনি তৃণমূল। বস্তুত, ফুরফুরা শরিফের একটি অংশও মনে করছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতির কারণেই ফিরহাদের বক্তব্যের নিন্দা করতে তৃণমূল সময় নষ্ট করেনি।

গত জুলাই মাসে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ফিরহাদ যা বলেছিলেন, তার নির্যাস— যাঁরা ইসলাম নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি, তাঁরা ‘দুর্ভাগা’। সেই বক্তৃতার ভিডিয়ো নিয়ে বিজেপির আইটি সেল হইচই করেছিল। জনমানসে আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু দলগত ভাবে তৃণমূলকে ফিরহাদের সেই বক্তব্যের সমালোচনা করতে দেখা যায়নি। এ বার সেই ফিরহাদই সংখ্যালঘুদের ‘সংখ্যাগুরু’ হয়ে ওঠার ডাক দিয়েছেন। বাংলাদেশের ঘটনার আবহে তাতে নড়েচড়ে বসতে হয়েছে এ পার বাংলার শাসকদলকে।

যে কোনও ‘বেফাঁস’ মন্তব্যের পরেই রাজনীতিকেরা যেমন করে থাকেন, ফিরহাদও তেমনই করেছেন। বলেছেন, তাঁর বক্তৃতার ‘অপব্যাখ্যা’ হচ্ছে। মন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমি আপাদমস্তক ভারতীয়। আমি কোনও সাম্প্রদায়িক কথা বলিনি। বিজেপি অপব্যাখ্যা করে সাম্প্রদায়িক তাস খেলার চেষ্টা করছে।’’ ফিরহাদের কন্যা প্রিয়দর্শিনী হাকিমও (যিনি রাজনীতিতে ‘শিশু পদক্ষেপ’ করা শুরু করেছেন) সেই কথাই বলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এমন কিছু বলা হয়নি, যার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা এনে নোংরামি করতে হবে। তবে এটা বিজেপির স্বভাব। আমাদের সকলের মাতৃভাষা বাংলা। উর্দুতে বলায় বিষয়টা একটু গুলিয়ে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।’’ কিন্তু দল স্পষ্ট করে দিয়েছে, ফিরহাদের ওই বক্তব্য তারা ‘অনুমোদন’ করে না। যা থেকে স্পষ্ট যে, ফিরহাদের ‘অপব্যাখ্যা’ ব্যাখ্যায় দল সন্তুষ্ট নয়।

বাংলাদেশের চলমান ঘটনা এ পার বাংলার জন্য রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক— তিন দিক থেকেই ‘স্পর্শকাতর’। কোচবিহার, দুই দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া-সহ রাজ্যের একাধিক জেলার সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। ও পারের আঁচ যাতে এ পারে এসে অশান্তি না ছড়ায়, সে ব্যাপারে প্রশাসনকে একাধিক বার সতর্ক করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এমনকি, গঙ্গাসাগর মেলায় যাতে কোনও অশান্তি না-ছড়ায় বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে ঘিরে, সে বিষয়েও অতিরিক্ত সতর্কতা নেওয়ার জন্য পুলিশ-প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ঘটনার প্রভাব রয়েছে। পর্যটন, চিকিৎসা পর্যটন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য মার খাচ্ছে। সেই কারণে রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূল ধৈর্য ধরে, ভারসাম্য রেখে, সংবেদনশীলতার সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মন্তব্য করছে।

সেই প্রেক্ষাপটেই ফিরহাদের সাম্প্রতিক মন্তব্য তৃণমূলের তাল কেটে দিয়েছে। কারণ, ফিরহাদ শুধু দলের প্রথম সারির নেতা নন। রাজ্যের মন্ত্রীও বটে। তা ছাড়া, তিনি যে কলকাতার মেয়র, সেই শহরেও গত কয়েক বছরে একাধিক ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, উপরে উপরে সম্প্রীতির সুর বাজলেও ভিতরে কোথাও কোথাও বিদ্বেষের বীজ রোপিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফিরহাদের বক্তব্য তৃণমূলের কাছে তাই সব দিক থেকেই ‘বিড়ম্বনার’। পাঁচ মাস আগে পরিপার্শ্ব তেমন ছিল না বলেই তখন ফিরহাদের বক্তব্য তৃণমূলের শিরঃপীড়ার কারণ হয়নি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি তেমন নয়।

একই সঙ্গে এই আলোচনাও রয়েছে যে, ফিরহাদ কেন একাধিক বার এমন ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য করছেন। কারণ দু’টি। প্রথমত, প্রাক্তন রেলমন্ত্রী তথা দীর্ঘ দিনের কংগ্রেস নেতা বরকত গনিখান চৌধুরীর মৃত্যুর পরে বাংলায় এমন কোনও সংখ্যালঘু নেতা উঠে আসেননি, যাঁর সারা রাজ্যেই ‘মুসলিম নেতা’ হিসাবে পরিচিতি রয়েছে। রাজ্যে আরও সংখ্যালঘু নেতা থাকলেও তাঁরা বিশেষ বিশেষ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকার নেতা। গত সাড়ে ১৩ বছরের তৃণমূল শাসনে সংখ্যালঘুদের ভোট শাসকদলের দিকে থাকলেও ফিরহাদ ছাড়া এমন কোনও সংখ্যালঘু নেতা উঠে আসেননি যাঁর কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ পর্যন্ত ‘দাপট’ রয়েছে। তৃণমূলের অন্দরে ‘ওজনদার’ নেতা তো বটেই, ফিরহাদ দাপুটে মন্ত্রীও। কিন্তু পাশাপাশিই ফিরহাদ কতটা পুরোপুরি ‘সংখ্যালঘুদের নেতা’ হয়ে উঠতে পেরেছেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, তিনি মহা ধুমধামে দুর্গাপুজোও করেন। অনেকের বক্তব্য, সেই কারণেই ফিরহাদ এই ধরনের মন্তব্য করে নিজেকে সংখ্যালঘুদের অবিসংবাদী নেতা করে তুলতে চাইছেন। দ্বিতীয়ত, তৃণমূলের অন্দরে অধুনা কিছু সংখ্যালঘু ‘মুখ’ গুরুত্ব পাওয়ায় ফিরহাদ ঈষৎ ‘সঙ্কটাপন্ন’। সেই মনোভাব থেকেও এই মন্তব্য বেরিয়ে থাকতে পারে।

তৃণমূলের নেতারা একান্ত আলোচনায় মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ইদানীং দলের সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন যথেষ্ট সক্রিয়। অতীতে ওই শাখা সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন বসিরহাটের প্রাক্তন সাংসদ তথা অধুনাপ্রয়াত নেতা হাজি নুরুল ইসলাম। সাগরদিঘি বিধানসভার উপনির্বাচনে তৃণমূলের হারের পরেই মমতা নুরুলের থেকে সংখ্যালঘু সেলের দায়িত্ব নিয়ে ইটাহারের বিধায়ক মোশারফকে দিয়েছিলেন। তৃণমূলের অন্দরের মনোভাব হল, নুরুলের সময়ে ওই সংগঠনে যে ‘স্থবিরতা’ ছিল, মোশারফ তা অনেকটা কাটাতে পেরেছেন। পাশাপাশিই, জাতীয় কর্মসমিতিতে তৃণমূল যুক্ত করেছে রাজ্যের মন্ত্রী জাভেদ আহমেদ খানকে। একদা সিপিএম এবং পরে কংগ্রেসে যোগ-দেওয়া রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুস সাত্তারকে মুখ্যমন্ত্রীর ‘উপদেষ্টা’র পদে নিযুক্ত করেছে নবান্ন। এমন নানাবিধ কারণে দলের অন্দরে সংখ্যালঘু নেতা হিসাবে ফিরহাদের ‘একক দাপট’ খানিকটা হলেও খর্ব হচ্ছে। সেই কারণেই ফিরহাদ সংখ্যালঘু প্রশ্নে ‘অতি সক্রিয়’ হয়ে থাকতে পারেন।

তৃণমূলের অন্দরে বলা হয়, মমতার দুই ‘ছায়া’ ববি (ফিরহাদ) এবং অরূপ বিশ্বাস। সেই ফিরহাদের মন্তব্য প্রসঙ্গে নিন্দা করে দলের বিবৃতি এবং মমতার রুষ্ট হওয়ার ঘটনা সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সমীকরণের প্রেক্ষাপটেও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। ইনফোসিসের ক্যাম্পাস উদ্বোধনের কর্মসূচিতে (যেখানে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা) বুধবার হিডকোর চেয়ারম্যান হিসেবে ফিরহাদের অনুপস্থিতি এবং বুধবারেই সংখ্যালঘু অধিকার দিবসের কর্মসূচিতে ‘প্রধান অতিথি’ হিসাবে ফিরহাদের নাম থাকলেও তাঁকে সেখানে না দেখতে পাওয়া সেই জল্পনায় ইন্ধন দিয়েছিল। আলোচনা চলছিল, ফিরহাদই কি ‘দূরত্ব’ রাখছেন না কি তাঁকে তেমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে? তবে বৃহস্পতিবার অ্যালেন পার্কে মুখ্যমন্ত্রীর পাশে ফিরহাদকে দেখা গিয়েছে। মুখে হাসিও ছিল। যা তৃণমূলে পাল্টা অভিমতের জন্ম দিয়েছে—পরিস্থিতি সাপেক্ষে দলকে ফিরহাদের বক্তব্যের নিন্দা করতে হয়েছে। কিন্তু সমীকরণে বিশেষ কোনও ‘বদল’ হবে না।

অন্য বিষয়গুলি:

FirhadHakim Tmc Leader KMC Mayor Controversial comments Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy