অসীম দেবশর্মা। নিজস্ব চিত্র।
শুরুতেই একটা কথা বলতে চাই। কোনও বাবাকেই যেন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয় কখনও। ঈশ্বরের কাছে আমার এই প্রার্থনা। হাতে আমার ছেলের লাশ। অথচ, আমি জানি না, আমার কী করা উচিত! কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কান্নাও পাচ্ছিল না আমার। শুধু উদ্ভ্রান্তের মতো এ দিক ও দিক ছোটাছুটি করছিলাম। আমাকে দেখে না-হোক, ছোট্ট ছেলেটার মরা মুখটা দেখে যদি কারও একটু দয়া হয়! কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না।
আমি কালিয়াগঞ্জের মুস্তাফানগরের ডাঙিপাড়ায় থাকি। মাস পাঁচেক আগে আমার আর আমার স্ত্রী সাগরীর যমজ সন্তান হয়। আমি পরিযায়ী শ্রমিক, কেরলে কাজ করি। দুই ছেলের অসুস্থতার খবর পেয়ে দিন কয়েক আগেই বাড়ি ফিরেছি। তার মধ্যে এ সব ঘটে গেল। আমার এক ছেলে দু’দিন আগে সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। বৃহস্পতিবারই ওকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। আর এক ছেলে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ওরই মৃত্যু হয় শনিবার রাতে।
রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ ছেলে মারা যায়। হাসপাতালে তখন আমিই ছিলাম। স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে পড়ি। তখনও বুঝিনি আমায় ওই দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে! ভেবেছিলাম, হাসপাতালই হয়তো সকালে অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে দেবে। কারণ, বৃহস্পতিবার আমার আর এক ছেলেকে অ্যাম্বুল্যান্সে করেই বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল সাগরী। বিনাপয়সায়। সেই মতো আমিও ১০২ নম্বরে ফোন করি। কিন্তু ওখান থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, ওরা লাশ নিয়ে যাবে না। নিয়ে যেতে হলে ৮ হাজার টাকা লাগবে! তখন আমার কাছে সত্যিই টাকা ছিল না। ১৫-১৬ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল। হাজার দু’য়েক টাকা মতো পড়ে ছিল পকেটে। আমি ওদের বললাম যে, পনেরোশো টাকায় পৌঁছে দিন। ওরা পরিষ্কার বলে দিল, ‘‘না, হবে না।’’
তখন সত্যিই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি। অত দূর কী ভাবে নিয়ে যাব ছেলেকে! টাকাও তো নেই। তখন ভাবতে ভাবতে ছেলের দেহ ব্যাগের ভিতর ভরে নিয়ে যাওয়ার ভাবনাটা মাথায় আসে। সকালে আমার সঙ্গে এক জন ছিল হাসপাতালে। সে-ই ২২০ টাকা দিয়ে একটা ব্যাগ কিনে এনে দেয় আমায়। ছেলের দেহ যখন ওই ব্যাগে ভরছিলাম, আমার গা-হাত-পা কাঁপছিল রীতিমতো! সঙ্গে কিছু কাপড়চোপড় ছিল। ওগুলো দিয়েই মুড়িয়ে ঢেকে রেখেছিলাম ছেলের দেহ। ওই কষ্টটা আমার পক্ষে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে ভীষণ ভয় করছিল। ব্যাগে একটা বাচ্চা ছেলের দেহ নিয়ে এতটা রাস্তা যাওয়া! কোনও ভাবে যদি রাস্তায় ধরা পড়ে যাই, এই ভয়টা পাচ্ছিলাম। ওখান থেকে প্রথমে রায়গঞ্জের বাসে উঠি। ব্যাগটা আমার কাছে বাঙ্কারে রেখেছিলাম। বাসে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছিলাম না আমি। খালি মনে হচ্ছিল, এই বুঝি কেউ এসে আমার ব্যাগটা খুলে দেখবে। কাঁদব কী, ভয়ে দরদর করে ঘামছিলাম! তখন আমার মাথায় শুধু ঘুরছিল যে, আমাকে আবার বাস পাল্টাতে হবে। আবার একটা অন্য বাসে উঠতে হবে।
যাই হোক, রায়গঞ্জে নামলাম। বাসের লোকটাই বলে দিয়েছিল, অন্য বাসটা কোথা থেকে ধরতে হবে। রায়গঞ্জে নেমেই বাড়িতে ফোন করি। সবটা জানাই। তার পর বাস ধরে কালিয়াগঞ্জে পৌঁছই। বাসস্ট্যান্ডে নেমে দেখি প্রচুর লোকজন। মিডিয়াও এসেছে। অ্যাম্বুল্যান্সও ছিল। গৌরাঙ্গদা (বিজেপি কাউন্সিলর গৌরাঙ্গ দাস) খবর পেয়ে একটা অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কালিয়াগঞ্জে বিবেকানন্দ মোড় থেকে আমার গ্রাম ৮ কিলোমিটার দূরে। অ্যাম্বুল্যান্সে করেই ওই রাস্তাটা ফিরেছিলাম। ছেলের শেষকৃত্য করেছি। সুষ্ঠু ভাবেই সেটা হয়েছে।
পরে বিডিও অফিস থেকে যোগাযোগ করেছিল আমার সঙ্গে। গোটা ঘটনাটা আমার কাছে জানতে চায় ওরা। সব শুনে বলে যে, হাসপাতাল থেকে দেহ নিয়ে আসার নাকি ব্যবস্থা রয়েছে! কিন্তু ওখানে এ রকম কোনও সাহায্য আমি পাইনি। আমায় কেউ কিছু বলেও দেয়নি। কী করে জানব আমি? আমি কয়েক জন ড্রাইভারকে ফোনও করেছিলাম। সকলের একই কথা, ‘‘টাকা ছাড়া যাব না।’’ আমি গরিব মানুষ। কোনও উপায় না দেখে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। বাবা হয়ে ছেলের লাশ ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে!
(অনুলিখন: আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy