ছেলের সঙ্গে ঝুমা। নিজস্ব চিত্র
দোতলায় এক চিলতে ঘরে চৌকি পাতা। পাশে একটা টেবিলে গ্যাস পেতে রান্নার আয়োজন। পাশের ঘরে আরেকটা চৌকি।
লালগড়ের বামুনপাড়ায় ভাড়া বাড়ির দোতলায় আটপৌরে সংসারের কর্ত্রী ঝুমা দণ্ডপাটের চোখ দেখলেই বোঝা যায়, জমে আছে অনেক কান্না। তিনি নিজেও বলছেন, ‘‘প্রথম কয়েক মাস খুব কেঁদেছিলাম। পরে বুঝলাম কেঁদে কিছু হবে না। ছেলে-মেয়েকে মানুষ করতে হবে।’’
লড়াইয়ে বেশ কয়েক কদম এগিয়েও গিয়েছেন ঝুমা। ছেলে সৌম্যদীপ কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা করে চাকরি করছেন কলকাতার এক প্রকাশনা সংস্থায়। আর মেয়ে স্নেহা লালগড়ের স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ছে।
ঝুমার স্বামী রথীন দণ্ডপাট। নেতাই গণহত্যা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত রথীন ২০১৪ সাল থেকে বিচারাধীন বন্দি। অভিযোগ, নেতাই গ্রামে রথীনের বাড়ির ছাদ থেকেই গ্রামবাসীকে লক্ষ করে গুলি চালানো হয়েছিল। ২০১১ থেকে ‘খুনির পরিবার’ হিসেবে দেগে যাওয়াটা এখনও মানতে পারেন না ঝুমা। শনিবারও তিনি বললেন, ‘‘আমার স্বামী যে নির্দোষ সেটা একদিন প্রমাণ হবেই। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ঘটনার দিন উনি তো আমার সঙ্গে ঝাড়গ্রামে ছিলেন। ভাড়া বাড়িতে টিভিতে খবরটা দেখে আমরা চমকে গিয়েছিলাম।’’
নেতাই মামলা চলছে। গত পাঁচ বছর রথীনের ঠিকানা মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার। শুক্রবার রথীনের উপস্থিতিতেই আদালতের নির্দেশে নেতাই গ্রামের বাড়ি ফিরে পেয়েছেন ঝুমারা। ঝুমা জানালেন, ২০০৯ সালে মাওবাদী-জনসাধারণের কমিটির হুমকিতে ওই বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল তাঁদের। তার আগে সৌম্যদীপকে জলচকের আবাসিক স্কুলে ভর্তি করেন। রথীন ও ঝুমা ঝাড়গ্রামে বাড়ি ভাড়া নেন। মেয়েকে ভর্তি করান শহরের নার্সারি স্কুলে। ঝুমার দাবি, ‘‘আমরা নেতাইয়ের বাড়িতে তালা দিয়ে চলে এসেছিলাম। পরে কী হয়েছিল জানি না। নেতাইয়ের ঘটনার পরে আমাদের বাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল বলে খবর পেয়েছিলাম।’’ ঝুমা জানান, নেতাইয়ের ঘটনায় জড়িয়ে যাওয়ায় তাঁর স্বামী প্রথমে কলকাতায় গা-ঢাকা দেন। পরে চলে যান হায়দরাবাদে। ঝুমা মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন লালগড়ে আত্মীয়ের বাড়িতে। সৌম্যদীপ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত জলচকের স্কুলে পড়ে চলে আসে মায়ের কাছে। নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয় লালগড় রামকৃষ্ণ বিদ্যালয়ে। ২০১৪ সালে সৌম্যদীপের মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের আগেই হায়দরাবাদে ধরা পড়েন রথীন।
কঠিন সেই সময়েই ভেঙে পড়েননি সৌম্যদীপ। তিনিও বলছেন, ‘‘বাবা কোনও দোষ করেননি। রাজনৈতিক স্বার্থে বাবাকে খুনের মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেটা এলাকারও সবাই জানেন। সে জন্যই তো আমরা নেতাইয়ে জ্ঞাতি-কুটুমদের বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাতায়াত করতে পারছি।’’
বাবা জেলে। মা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ঠাকুমার ফ্যামিলি পেনশন পান আর মামাবাড়ির সাহায্যে তাঁদের ভাই-বোনকে ঝুমা পড়িয়েছেন বলে জানালেন সৌম্যদীপ। সঙ্গে জুড়লেন, ‘‘যে ভাবেই হোক রোজগার করতে হবে এটাই ছিল আমার লক্ষ্য।’’ পলিটেকনিক ডিপ্লোমা থাকলে কাজের সুযোগ রয়েছে। তাই বর্ধমানের কালনা পলিটেকনিক থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা কোর্স করেন ২০১৮তে। বছর একুশের সৌম্যদীপ মাস ছ’য়েক হল চাকরি পেয়েছেন। ছেলেবেলা কাটানো নেতাইয়ের বাড়িতে ফিরতে চান সৌম্যদীপ। বলছিলেন, ‘‘বাড়িটার খারাপ অবস্থা। দ্রুত সারিয়ে পূর্বপুরুষের ভিটেতে ফিরতে চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’’
কিন্তু গ্রামে থাকতে অসুবিধা হবে না? এক চিলতে হাসি খেলে গেল ছিপছিপে চেহারার উজ্জ্বল মুখটায়। গণহত্যায় অভিযুক্ত সিপিএম কর্মীর ছেলে বললেন, ‘‘রথীন দণ্ডপাটের ছেলে বলে পরিচয় দিতে আমার এতটুকু গলা কাঁপে না। নেতাইবাসী সত্যিটা জানেন। আমিও নিশ্চিত সুবিচার পাবই।’’
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy