E-Paper

এত ধীরে মামলা! খুনের কিনারায় সিবিআই দাবি

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, রক্তাক্ত বরুণকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেনি তারা। প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছিল বনগাঁ জিআরপি।

বরুনের দিদি প্রমীলা রায়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

বরুনের দিদি প্রমীলা রায়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র  

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:২৭
Share
Save

গোবরডাঙা থেকে স্বরূপনগরের চারঘাটের দূরত্ব কিলোমিটার সাতেক। বরুণ বিশ্বাসের খুনের অকুস্থলও বদলে গিয়েছিল সাত কিলোমিটার।

বরুণ খুনে অভিযুক্তদের জেরা করে সিআইডি জানতে পেরেছিল, প্রতিবাদী এই যুবককে অনেক দিন ধরেই ‘নিশানা’ করা হচ্ছিল তলে তলে। চারঘাটে একটি ধর্মীয় স্থানে নিয়মিত যেতেন বরুণ। এক বার ভাবা হয়েছিল, সেখানেই ‘খতম’ করা হবে তাঁকে। নানা কারণে এই ‘অপারেশন’ সফল হয়নি। পরের ঘটনাস্থল গোবরডাঙা স্টেশন চত্বর। ঠিক বাইরে যেখানে মোটরবাইক রাখা থাকে, সেই এলাকা। কেন?

ষড়যন্ত্রকারীরা মনে করেছিল, গুলি করে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া সহজ হবে। সেই মতো ছক কষা হয়। সে সব যাচাই করতে স্টেশন চত্বরে একাধিক বার ‘রেকি’ করেছিল তারা। কোন জায়গায় গুলি করা হবে, গুলি করার পরে কী ভাবে তারা পালাবে— সব আটঘাট আগে থেকেই বাঁধা হয়েছিল।

তার পরে এল ২০১২ সালের ৫ জুলাই। পরে প্রত্যক্ষদর্শী এবং অভিযুক্তদের কাছ থেকে জানা যায়, বরুণের উপরে গুলি চালিয়েছিল বছর সতেরোর এক কিশোর। সঙ্গে ছিল আরও কয়েক জন। খুনের পরে দুষ্কৃতীরা হেঁটে রেললাইন ধরে ঠাকুরনগর স্টেশনে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে যে যার বাড়ি চলে যায়।

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, রক্তাক্ত বরুণকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেনি তারা। প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছিল বনগাঁ জিআরপি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তদন্তভার নেয় সিআইডি। গ্রেফতার করা হয় অভিযুক্ত নাবালক-সহ ছ’জনকে।

সিআইডি জানিয়েছিল, সুটিয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের অন্যতম সাজাপ্রাপ্ত আসামী সুশান্ত চৌধুরী, দমদমসেন্ট্রাল জেলে বসে বলাই মালাকার নামে আর এক দুষ্কৃতীর সঙ্গে মিলে বরুণকে খুনের ফন্দি আঁটে। পুরনো আক্রোশই তার কারণ। বলাই জামিনে মুক্ত হয়ে সেই ষড়যন্ত্রকে বাস্তবে রূপ দেয়। খুনের মামলায় যেমন এক নাবালক-সহ ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়, তেমনই অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে সুশান্তকেও সিআইডি জেলে গ্রেফতার করে। পরবর্তী সময়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে অসুস্থ হয়ে সুশান্তের মৃত্যু হয়।

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বনগাঁ আদালতে সিআইডি ১০০ পাতার চার্জশিট জমা দেয়। ১০ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়। তাদের মধ্যে তিন জন এখনও পুলিশের খাতায় পলাতক। ঘটনার ৮৭ দিনের মাথায় জমা পড়া ওই চার্জশিটে ৫২ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল। তার পরে আদালতে চার্জগঠন করে শুরু হয় শুনানি। যা এগারো বছর ধরে এখনও চলছে। হাতে গোনা কয়েক জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে।

বনগাঁ আদালতের মুখ্য সরকারি আইনজীবী অসীম দে বলেন, ‘‘এত দিন স্থায়ী বিচারক না থাকায় শুনানি ধীরে চলছিল। এখন বিচারক চলে এসেছেন। পুজোর ছুটির পরে আদালত খুললে মামলাটির শুনানি ত্বরান্বিত করতে পদক্ষেপ করা হবে।’’

যদিও বরুণের বাড়ির লোকজনের দাবি সিআইডি নয়, সিবিআই তদন্ত হোক। বরুণের দিদি প্রমীলা রায় বিশ্বাস বার বারই প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীকে নিশানা করছেন। যদিও উল্টো দিকে, তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘ওই সময় (২০১১ সালের আগে) সুটিয়ায় দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করার ক্ষমতা সিপিএমের ছিল না। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বিরোধী দলের বিধায়ক হয়েও দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। বরুণ খুনের দায় তাঁর উপর চাপানো ঠিক নয়।’’

বরুণের অন্যতম সহযোদ্ধা ননীগোপাল পোদ্দারকেও নিশানা করেছিল দুষ্কৃতীরা। ২০০৩ সালের হামলার ঘটনায় এক জন জেল খাটে। ২০১১ সালের ঘটনায় কেউ গ্রেফতার হয়নি। সেই ননীগোপাল এখন বলছেন, ‘‘বরুণ খুনে মদতদাতাদের শাস্তির দাবি আমাদের আছে। তবে কোনও প্রমাণ ছাড়া কারও নামে সরাসরি অভিযোগ করি কী করে!’’ কী ভাবে প্রমাণ করা সম্ভব? তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বিশ্বাস, সুশান্তর মাথা থেকে খুনের ছক বেরোয়নি। একমাত্র সিবিআই তদন্তেই এই ঘটনার মূল চক্রান্তকারীদের ধরা সম্ভব।’’ সিবিআইয়ের প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা উপেন বিশ্বাসও বলেন, ‘‘আমার মনে হয় আদালতের নির্দেশে সিট গঠন করে, কোর্টের নজরদারিতে সিবিআই তদন্তই এক মাত্র সত্য উদঘাটন হওয়া সম্ভব।’’

এলাকায় দরদী মানুষ হিসাবেই পরিচিত ছিলেন বরুণ। তাঁর পাড়ার এক বৃদ্ধ বললেন, ‘‘যে কোনও প্রয়োজনে আমাকে সাহায্য করত। আর কত দিনই বা বাঁচব! মৃত্যুর আগে দেখে যেতে চাই, বরুণের খুনিরা সাজা পেয়েছে।’’ এলাকার লোকজন জানালেন, নিজের বেতনের টাকা থেকে গরিব ছেলেমেয়েদের বই কিনে দিতেন। তাদের পড়াতেন। কারও বিয়ে, কারও চিকিৎসার খরচ জোগাড় করে দিতেন।

বরুণের সব বড় কাজ সম্ভবত গণধর্ষণের ঘটনায় সাক্ষীদের সংগঠিত করা, তাঁদের নিয়মিত আদালতে নিয়ে যাওয়া এবং বাড়ি ফিরিয়ে আনা। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নির্যাতিতা তরুণীদের ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা অনেকে এখন স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করছেন।

এক নির্যাতিতার কথায়, ‘‘বরুণদা ছিলেন আমার মতো বহু মেয়ের কাছে ভগবান। অথচ, আমাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ওঁকেই প্রাণ দিতে হল!’’

(শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Barun Biswas Murder Case Barun Biswas CBI

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।