Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Ration Distribution Case

তাড়া খেয়ে পালানোর ১৯ দিন পর শাহজাহান-ডেরায় আবার ঢুকল ইডি! কী পেল, কী পেল না, লাভ হল কি?

১৯ দিন পর সন্দেশখালিতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিল ইডি। সকাল ৭টা ৪৫ মিনিট থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত তল্লাশি চলে। তবে উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই শাহজাহানের বাড়িতে পায়নি ইডি।

ED raid in Shahjahan Sheikh’s house in Sandeshkhali

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ ২৩:০৩
Share: Save:

সন্দেশখালিতে তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখের বাড়িতে ১৯ দিন পর রেশন ‘দুর্নীতি’কাণ্ডে দ্বিতীয় বারের জন্য অভিযান চালাল ইডি। বুধবার সকাল থেকে সেখানে তল্লাশি চলে। বাড়ির তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকেন কেন্দ্রীয় আধিকারিকেরা। দুপুরে ওই বাড়ি সিল করেও দিয়ে গিয়েছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে দরজায় সেঁটে দিয়েছেন একটি নোটিস। যেখানে পাঁচ দিনের মধ্যে ‘নিখোঁজ’ শাহজাহানকে কলকাতায় ইডি-র দফতরে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। শাহজাহানকে ২৯ জানুয়ারি সকাল ১১টার মধ্যে সিজিও কমপ্লেক্সে যেতে বলেছে ইডি।

পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে এ বার সন্দেশখালিতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিল ইডি। সঙ্গে ছিলেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর শতাধিক নিরাপত্তারক্ষী। ২৫টি গাড়িতে ১২৫ জনেরও বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্য নিয়ে ছ’জনের দল সকাল ৭টা নাগাদ শাহজাহানের বাড়িতে পৌঁছয়। তাঁরা কার্যত রণসাজে সজ্জিত হয়ে গিয়েছিলেন সন্দেশখালিতে। সেই সঙ্গে রাজ্য পুলিশকেও আগে থেকে জানিয়ে রেখেছিল ইডি। তারা পৌঁছলে রাজ্য পুলিশের আধিকারিক এবং র‌্যাফও শাহজাহানের বাড়ির সামনে হাজির হয়। গোটা এলাকা পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীতে ছয়লাপ হয়ে যায়। সকলের মাথায় ছিল হেলমেট এবং হাতে ছিল আধুনিক অস্ত্র। দুপুর ২টো পর্যন্ত চলে তল্লাশি অভিযান।

এর আগে ৫ তারিখ এই সন্দেশখালিতেই স্থানীয় জনতার হাতে আক্রান্ত হয়েছিল ইডি। শাহজাহানের বাড়ির সামনে তারা পৌঁছতেই ধীরে ধীরে লোক জড়ো হতে শুরু করে। ইডির দাবি, ৮০০ থেকে ১০০০ লোক সে দিন তাদের ঘিরে ধরেছিলেন। প্রত্যেকেই শাহজাহানের অনুগামী। তাঁদের আক্রমণে ইডির তিন আধিকারিককে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। মাথাও ফাটে এক জনের। সে দিন সন্দেশখালির বাড়িতে শাহজাহানের দেখা পায়নি ইডি। তার আগেই মার খেয়ে তাদের ফিরে যেতে হয়। পরে আদালতে ইডি জানায়, শাহজাহান সে দিন বাড়ির ভিতরেই ছিলেন। সেখান থেকে ফোন করে তিনি বাড়ির বাইরে লোক জড়ো করেছিলেন। হট্টগোলের মাঝে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। তার পর থেকে শাহজাহানের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ইডির সন্দেহ ছিল, শাহজাহান বাংলাদেশে গা ঢাকা দিয়েছেন।

সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে ন্যাজাট থানায় তিনটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল খোদ ইডির বিরুদ্ধে। মার খাওয়া আধিকারিকদের বিরুদ্ধে হওয়া এফআইআরকে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে যায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সেখান থেকে ইডির বিরুদ্ধে তদন্তে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে। সেই টানাপড়েনের মাঝে ১৯ দিন পর আবার ইডি সন্দেশখালিতে যায়। তবে বুধবারের তল্লাশিতে শাহজাহানের বাড়ি থেকে তেমন কিছুই পায়নি ইডি।

রণসাজে ইডি

গত ৫ জানুয়ারি সন্দেশখালিতে রেশন ‘দুর্নীতি’র তদন্তে গিয়ে আক্রমণের মুখে পড়েছিল ইডি। বুধবার তাই আগে থেকে তারা প্রস্তুত হয়েই গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর শতাধিক সদস্য। প্রত্যেকের মাথায় হেলমেট এবং হাতে ছিল আধুনিক অস্ত্র। পুলিশকেও আগেভাগে খবর দিয়ে গিয়েছিল ইডি। যাতে প্রয়োজন হলে পুলিশের সহযোগিতা পাওয়া যায়।

ইডি-পুলিশ পাশাপাশি

মঙ্গলবারই বসিরহাট পুলিশ জেলার উচ্চপদস্থ কর্তাদের ইডি জানিয়েছিল, তারা শাহজাহানের গ্রামে যাচ্ছেন। তার পর বুধবার সকালে ইডি পৌঁছলে তাদের সঙ্গেই ঘটনাস্থলে যান ন্যাজাট থানার ওসি। সঙ্গে ছিল রাজ্য পুলিশের বিশাল বাহিনী। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত র‌্যাফও শাহজাহানের বাড়ির সামনে পাঠানো হয়। রাজ্য পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় জওয়ানেরা পাশাপাশি থেকে শাহজাহানের বাড়ি পাহারা দেয়। খাকি, জলপাই পোশাকের দীর্ঘদেহীরা রাস্তা প্রায় মুড়ে রেখেছিলেন।

ভাঙল অনেক তালা

শাহজাহানের বাড়িতে গিয়ে ইডিকে পদে পদে বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বাড়িটি তালাবন্ধ ছিল। কোনও চাবি পাওয়া যায়নি। ফলে তালা ভেঙে ভিতরে ঢোকেন ইডি কর্তারা। সেখানে গিয়েও আলমারি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ড্রয়ারের তালা ভাঙতে হয়েছে বলে ইডির দাবি। শাহজাহানের বাড়িতে সদর দরজার দু’টি-সহ মোট ১৯টি তালা ভাঙা হয়েছে।

ইডির ভাঁড়ার ‘শূন্য’

শাহজাহানের বাড়িতে তালা ভেঙে ঢুকে চিরুনিতল্লাশি চালিয়েও তেমন কিছু হাতে পায়নি ইডি। বাড়ি ছিল কার্যত ‘সাফ’। কিছু জামাকাপড়, বাসন মিলেছে। তবে তা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। পাঁচটি পুরনো ৫০০ টাকার নোটও পাওয়া গিয়েছে এক তলার একটি ঘর থেকে। তা বাজেয়াপ্ত করেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। তবে ওই নোট অকেজো।

তবু কিছু রহিল বাকি

শাহজাহানের বাড়ি থেকে একেবারে খালি হাতে ফেরেনি ইডি। তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া গিয়েছে কলকাতার নামী গয়নার দোকান থেকে কেনা বেশ কিছু গয়নার বিল। এ ছাড়া, পাওয়া গিয়েছে প্রচুর রেজিস্ট্রি-ছাড়া দলিল। শাহজাহানের বাড়িতে ছিল অনেকের বিমানের টিকিট, ভিসা, বিমার সার্টিফিকেট সংক্রান্ত নথির কাগজ। ছিল বিভিন্ন নির্বাচন কেন্দ্রের প্রার্থীদের ‘ফর্ম ১২’ সার্টিফিকেট সং‌ক্রান্ত নথিপত্র। চার জনের ল্যামিনেট করা আসল ‘ফর্ম-২৩’ও পাওয়া গিয়েছে শাহজাহানের বাড়িতে। ওই চার জনের নাম শিবপ্রসাদ হাজরা, বিকাশ মণ্ডল, প্রতিমা সর্দার এবং সবিতা রায়। ওই বাড়ি থেকে ইডি পেয়েছে ‘শাহজাহানের বাজার’ বা শেখ শাহজাহান মার্কেটের বিস্তারিত প্রজেক্ট রিপোর্টের বই এবং তিন জনের সঙ্গে শাহজাহানের বিশেষ চুক্তিপত্র বা নোটারিয়াল সার্টিফিকেট। তাঁরা হলেন পিন্টু বসু, আল্পনা ভদ্র এবং বাবুনা রায়। এ ছাড়াও ১০টি ল্যামিনেটেড কাগজে বাংলায় লেখা পর্চা, ২০১৮ সালে শাহজহানের দেওয়া আয়কর রিটার্নের ফাইল পেয়েছে ইডি।

১৯ দিন তো কম নয়!

তল্লাশি চালানোর সময়ে শাহজাহানের বাড়িতে উপস্থিত এক ইডি আধিকারিককে বলতে শোনা যায়, ‘‘১৯ দিন তো কম নয়!’’ অর্থাৎ, বাড়িতে কিছু থাকলেও এই দীর্ঘ সময় পরে তা আর থাকার কথা নয়। সবই সরিয়ে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে, সন্দেহ কেন্দ্রীয় সংস্থার। রেশন সংক্রান্ত নথি কিছুই ইডি পায়নি।

কী বললেন ইডির গাড়িচালক

ইডির গাড়িচালক ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা মঙ্গল রজ্জাক ১৯ দিন আগেও ছিলেন। বুধবারও তিনিই ইডি আধিকারিকদের সন্দেশখালিতে নিয়ে গিয়েছেন। দু’দিনের দুই চিত্রপটে আকাশপাতাল ফারাক তাঁর নজর এড়ায়নি। মঙ্গল বলেন, ‘‘সে দিন সব কিছুই অন্য রকম ছিল। এত লোক চারপাশে ঘিরে ধরছিল। আগুন, লাঠি, চিৎকার-চেঁচামেচি... আজ সব চুপচাপ। মনেই হচ্ছে না এখানেই আগের দিন এত কিছু হয়েছে! আজ আর ভয় করছে না।’’

চাবি রাখবে কে?

তালা ভেঙে শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি চালানোর পর নতুন তালা লাগিয়ে দিয়ে যান ইডি আধিকারিকেরা। কিন্তু সেই নতুন তালার চাবি কার কাছে থাকবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। ইডি সূত্রে খবর, শাহজাহানের বাড়িতে তালা দিয়ে দেওয়ার পর চাবি কেউ রাখবেন কি না, জানতে তৃণমূল নেতার ভাইদের বাড়িতে যান তদন্তকারী আধিকারিকেরা। তবে শাহজাহানের কোনও ভাই-ই সেই চাবি রাখতে রাজি হননি।

‘নিখোঁজ’ নেতাকে তলব

৫ জানুয়ারির পর থেকেই শাহজাহানের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বুধবার তাঁর বাড়িতে তল্লাশি অভিযান শেষে শাসকদলের সেই ‘নিখোঁজ’ নেতাকেই তলব করেছে ইডি। আগামী ২৯ জানুয়ারি সকাল ১১টার মধ্যে কলকাতায় ইডির দফতর সিজিও কমপ্লেক্সে তাঁকে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। এই মর্মে শাহজাহানের দরজায় একটি নোটিস সেঁটে দিয়েছে কেন্দ্রীয় আধিকারিকেরা। তাঁর বাড়িটিও সিল করে দেওয়া হয়েছে।

মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি!

ইডি আধিকারিকদের ঘিরে ধরে ১৯ দিন আগে যেখানে চড়থাপ্পড়ের বন্যা বয়ে গিয়েছিল, বুধবার সকালে সেই জায়গাই হয়ে গিয়েছিল বিলকুল ফাঁকা। কোনও প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। আগের দিনের ঘটনা কেউ কিছুই দেখেননি। কেউ কিছুই বলতে রাজি নন। রকমসকম দেখে তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ ছবির কথা মনে পড়ে যেতে বাধ্য। যেখানে পাড়ার ছেলেরা এসে জানালা দিয়ে এক প্রবীণ শিক্ষককে (পড়ুন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বলে যেত, ‘‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।’’ আর নিজের চোখের সামনে কন্যার (পড়ুন শতাব্দী রায়) শ্লীলতাহানির ঘটনা দেখেও মুখ বুজে থাকতে হত তাঁকে। শাহজাহানের পড়শিদের মধ্যেও যেন ৫ জানুয়ারির ঘটনা নিয়ে সেই মনোভাব দেখা গেল বুধবার।

অন্য বিষয়গুলি:

West Bengal Ration Distribution Case Bengal Ration Case ED sandeshkhali Shahjahan Sheikh ED Raid in Sandeshkhali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy