অয়ন শীলের বাড়ি থেকে উদ্ধার ওমর শিট দিয়ে লেখা ইডি। ফাইল চিত্র।
স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই প্রায় প্রতিদিন উঠে আসছে চমকে দেওয়া তথ্য। দুর্নীতির অঙ্ক এবং ব্যাপ্তিও অবাক করে দিচ্ছে অনেককে। এই ধারা অব্যাহত রেখে মঙ্গলবার আদালতে ইডি-র দাবি, শুধু প্রাথমিকে নিয়োগেই দুর্নীতি হয়েছে অন্তত ১০০ কোটি টাকার। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির সূত্রে দাবি, আগামী দিনে তদন্ত এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে এই অঙ্ক বহু গুণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা।
কোর্টে ইডি জানিয়েছে, এই দুর্নীতিতে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য তো বটেই, ওতপ্রোত ভাবে জড়িত কুন্তল ঘোষ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, অয়ন শীলরাও।
শুধু তা-ই নয়, জেলবন্দি হয়ে থাকা সত্ত্বেও মানিক যে প্রভাবশালী, তা দাবি করে ইডি-র দুই আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি এবং অভিজিৎ ভদ্রের বক্তব্য, নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় জেলে থাকা সত্ত্বেও মানিককে দল থেকে সরানো হয়নি। সেই সঙ্গে, মানিকের পরিবার কী ভাবে এই দুর্নীতিতে জড়িত, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁরা। হাতিয়ার করেছেন মানিকের ছোট ভাই হীরালাল ভট্টাচার্যের বয়ানও।
মানিক, তাঁর স্ত্রী শতরূপা, পুত্র সৌভিককে এ দিন কলকাতার বিচার ভবনের পিএমএলএ কোর্টের বিচারক শুভেন্দু সাহার এজলাসে হাজির করানো হয়। সেখানেই ইডি-র কৌঁসুলিরা জানান, মানিক তাঁর ভাইয়ের অ্যাকাউন্ট জোর করে ব্যবহার করেছেন। সেই অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করা হয়েছে। সেই তদন্ত করতে গিয়ে মানিকের ভাইয়ের বয়ান নথিবদ্ধ করেছেন তদন্তকারীরা। ইডির দাবি, হীরালাল বলেছেন যে, মানিক ভট্টাচার্য তাঁর দাদা, এটা তাঁর দুর্ভাগ্যের বিষয়। মানিক-পুত্র সৌভিকও কী ভাবে দুর্নীতিতে যুক্ত, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইডি-র আইনজীবীরা জানান, সৌভিকের দু’টি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা জমা হয়েছিল।
তদন্তকারী সংস্থাটির অভিযোগ, মানিক ও সৌভিক নিয়োগ দুর্নীতির টাকা লুট করেছেন। মানিক সপরিবারে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন। অথচ সেই বেড়ানোর খরচের বিপুল টাকা কোথা থেকে এল, তা স্পষ্ট নয়। এ দিন শুনানির পরে মানিককে ১৮ মে পর্যন্ত জেল হেফাজতে পাঠিয়েছেন বিচারক। শতরূপা এবং সৌভিকের জামিনের আর্জি সংক্রান্ত নির্দেশ বুধবার ঘোষণা করা হতে পারে।
এ দিন কোর্টে নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত প্রোমোটার অয়ন শীলের কথাও উঠেছে। ইডি-র দাবি, অয়নকে গ্রেফতারের পরে স্কুলের পাশাপাশি পুরসভাতেও নিয়োগ দুর্নীতির কথা জানা গিয়েছে। সেই বিষয়টি সিবিআইকে জানানো হয়েছে। অয়নের সঙ্গে মানিকের যোগসূত্রেরও দাবি করেছে ইডি। তাদের দাবি, মানিকের সঙ্গে যোগসাজশেই প্রায় ১০০ কোটি টাকা তুলেছিলেন অয়নরা।
মানিক এ দিন সাদা পুঁটুলিতে মুড়ে নথিপত্র নিয়ে কোর্টে এসেছিলেন। তাঁর আইনজীবী সঞ্জয় দাশগুপ্ত মক্কেলের হয়ে জামিনের সওয়ালে বলেন, মানিক তদন্তে সাহায্য করেছেন। এবং তার পরেই জানান, তাঁর মক্কেল আদালতে কিছু বলতে চান। কিন্তু একদা যোগেশচন্দ্র আইন কলেজের অধ্যক্ষ মানিক সওয়াল শুরু করার আগেই বিচারক বলেন, “শুনেছি উনি আইন (কলেজের) অধ্যক্ষ ছিলেন। আদালতের রীতিনীতি জানা উচিত। আপনার আইনজীবী সওয়াল করেছেন। উনি কী বলবেন?” মানিক কোর্টে তাঁর বিরুদ্ধে জমা পড়া পাঁচ হাজার পাতার চার্জশিটের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, তিনি ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারার প্রয়োগ নিয়ে বলবেন। বিচারক তাঁকে থামিয়ে বলেন, “হাই কোর্টে যান। এখানে নয়।” প্রসঙ্গত, সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত জীবন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষার অধিকারের বিষয়েই এ দিন বলেছিলেন মানিক। ভারতীয় সংবিধানের ২১ নম্বর ধারার প্রয়োগের মামলা যদিও হাই কোর্টে করতে হয়।
মানিক শুধু ‘একটি কথা’ বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিচারক সেই অনুমতি দেননি, বরং তাঁকে তর্ক করতে নিষেধ করেন। মানিকের আইনজীবীর উদ্দেশে বিচারক শুভেন্দু সাহা বলেন, “আইন কলেজের অধ্যক্ষকে বলুন, হাই কোর্টে যেতে।”
এ দিন জামিনের আর্জি জানিয়েছেন শতরূপা এবং সৌভিকের আইনজীবীরাও। শতরূপার আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায় বলেন, আদালত সমন জারি করেছিল। শতরূপা সশরীরে হাজির হয়েছিলেন। এখন তিনি জেলবন্দি। শতরূপা একজন গৃহবধূ, বয়স্ক মহিলা। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। যে কোনও শর্তে জামিন মঞ্জুর করা হোক। ইডি-র আইনজীবীরা পাল্টা বলেন, সমন বেআইনি হলে হাইকোর্টে আবেদন করতে পারতেন শতরূপা। কিন্তু তিনি তা করেননি। বরং হাই কোর্টে জামিনের আবেদন করেছেন। সে ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতে জামিনের শুনানি হতে পারে না। ইডির অভিযোগ, শতরূপা বিদেশ ভ্রমণ করলেও, ভ্রমণের খরচের টাকার উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উপরন্তু মৃত ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর যৌথ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের হদিস পাওয়া গিয়েছে। তিনিও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।
সৌভিকের আইনজীবী অমিত ভট্টাচার্য বলেন, সৌভিক প্রথম থেকেই তদন্তে সহযোগিতা করছেন। তদন্তকারীদের মুখোমুখি হয়েছেন। বর্তমানে জেল হেফাজতে থাকলেও, তদন্তকারী সংস্থা একবারও জেলে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। সৌভিকের লন্ডনে বাড়ি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছিল তদন্তকারী সংস্থা। কিন্তু তার কোনও তথ্যপ্রমাণ পেশ করতে পারেনি। যে কোনও শর্তে সৌভিকের জামিন মঞ্জুর করা হোক। কিন্তু সৌভিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে হিসাবহীন পাঁচ কোটি টাকা, বেসরকারি কলেজ সংগঠনের সঙ্গে লেনদেন ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে জামিনের বিরোধিতা করেন ইডি-র কৌঁসুলিরা।
এরই মধ্যে, এ বার ২০১২ সালের প্রাথমিক নিয়োগেও নজর পড়েছে ইডির। সূত্রের খবর, এ দিনই প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের দুই প্রতিনিধি গিয়ে ২০১২ এবং ২০১৪ সালের প্যানেল জমা দিয়েছেন তদন্তকারীদের। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সচিব রত্না বাগচীকে। মানিক যখন পর্ষদের সভাপতি পদে ছিলেন তখন পর্ষদের সচিব ছিলেন রত্না। সূত্রের দাবি, সেই কারণেই সেই সময়ের তথ্য জানতে রত্নাকে তলব করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, এই তদন্তের গোড়ায় রত্নাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল সিবিআই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy