মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। —ফেসবুক।
সিপিএম কি তার ভবিষ্যতের মুখ পেয়ে গেল? প্রশ্নটা আরও সঙ্গত এবং জোরালো করে দিল রবিবারের ব্রিগেড।
মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায় কি সিপিএমের যুব সংগঠনের ক্যাপ্টেন? এ নিয়ে এক বছর আগেও দলে বিতর্ক ছিল। রক্ষণশীলেরা বলতেন, ব্যক্তিপুজো নৈব নৈব চ! তাঁরা যা-ই বলুন, রাজনীতিতে মুখ যে বড় বিষয়, তা প্রমাণ হয়েছে বারবার। নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রাই শুধু নন, অতীতে সিপিএমকেও ক্ষমতা পেতে বা ধরে রাখতে জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো মুখকেই সামনে রাখতে হয়েছে। বুদ্ধবাবুর পর সেই মুখের অভাব সিপিএম অনুভব করেছে বার বার। ২,৯১০ কিলোমিটারের ইনসাফ যাত্রা যেন রক্ষণশীলতাকে বালির বাঁধের মতো ধসিয়ে দিয়ে, সিপিএমের সামনে এক মুখের সম্ভাবনা তৈরি করে দিল। মহম্মদ সেলিম থেকে বিমান বসুর মতো প্রবীণেরা মেনে নিয়েছেন, মিনাক্ষীর জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। কুলটির এই তরুণীর টানেই ঘরে ঢুকে থাকা কর্মীরা ফের ঝান্ডা ধরছেন। আর রবিবারের দুপুরবেলা জানান দিয়ে দিল, তাঁর নামেই ব্রিগেড।
বক্তা হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ার পরেই উদ্বেল হল ব্রিগেড। গোটা মাঠে নামে নানা স্লোগানের কোরাস। যে স্লোগানের অনুরণনের জন্য ২৫ সেকেন্ড চুপ করে থাকতে হল মিনাক্ষীকে। তার পর প্রথম শব্দ বললেন, ‘‘লাল সেলাম’’। বলামাত্র আবার গণকলরব। তার পর মিনাক্ষী যে কথা বললেন তাতেই স্পষ্ট হয়ে গেল, হয়তো তিনিও আন্দাজ করতে পারছেন, তাঁর বলা হয়ে গেলে মাঠ ফাঁকা হতে শুরু হবে। তখনও সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বলা বাকি। মিনাক্ষী বলেন, ‘‘আপনাদের থেকে একটা জিনিস চাইতে পারি তো?’’ জনতা জানান দিল, ‘‘হ্যাঁ’’। মিনাক্ষী ঘোষণা করলেন, তাঁর বলার পর সেলিম বলবেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ হবে, তার পর সবাই যেন মাঠ ছাড়েন। কিন্তু দেখা গেল, মিনাক্ষীর ২২ মিনিটের বক্তৃতার পরেই জমাট ভিড় ছানা কাটতে শুরু করেছে।
২০১১ সালের পর থেকে সিপিএম বেশ কিছু তরুণ মুখকেই সামনে আনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নানা কারণেই তাঁরা সে ভাবে দাগ কাটেননি। কিছু অল্পবয়সি নেতানেত্রীকে নিয়ে সেলফি তোলার হিড়িক রয়েছে, বক্তা হিসেবে সভা করানোর চাহিদা রয়েছে, কিন্তু ‘নেতা’ হয়ে ওঠার রসদ নেই। এক প্রবীণ সিপিএম নেতা রবিবার সভা শুরুর বেশ খানিক ক্ষণ আগে ঘনিষ্ঠ আলোচনায় বলছিলেন, ‘‘মিনাক্ষীর মধ্যে কোনও চকচকে বিষয় নেই। আন্দোলন করেছে, মার খেয়েছে, জেল খেটেছে কয়েক সপ্তাহ। তার পর হাই থাইরয়েড, ডেঙ্গির ক্লান্তি উড়িয়ে হেঁটেছে মাইলের পর মাইল। নেতা তো আন্দোলনের গর্ভেই জন্ম নেয়।’’
রবিবার সকাল থেকে মিনাক্ষীকে দেখা গিয়েছে বিবিধ ভূমিকায়। কখনও তদারকি করেছেন বর্ষীয়ান নেতাদের বসার ব্যবস্থার, কখনও মাইক হাতে সভা শুরুর অনেক আগেই ভিড়কে মঞ্চের দুপাশ থেকে থেকে মাঝমাঠে আনার কাজ করছিলেন। তার আগেও অনেকে সেই ঘোষণা করছিলেন বটে। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছিল না। এ বার ব্রিগেডের মঞ্চ হয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে মুখ করে। প্রতিবার হয় উল্টো দিকে। ফলে বছরের পর বছর ব্রিগেডে আসা হাজার হাজার বাম কর্মীকে রবিবার কার্যত গোলকধাঁধায় পড়তে হয়েছিল। ফলে সভা শুরুর অনেক আগেই মঞ্চের পিছনে ও দুপাশে ঠাসা ভিড় ছিল। মিনাক্ষী মাইক হাতে যখন দিদিমণির মতো বললেন, ‘‘মাঝমাঠের দখল নিতে হবে। আপনারা পাশ থেকে মাঝখানে চলে আসুন।’’ তার পরেই দেখা গেল ভিড় সরছে গোটা ব্রিগেডে।
সভা শুরুর অনেক আগেই অনেক মানুষ বাঁশের ব্যারিকেড টপকে মিনাক্ষীকে দেখতে চেয়ে ভিড় জমিয়েছিলেন। দেখা গিয়েছে মিনাক্ষী যখন মঞ্চের সামনের স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলছেন জটলা করে, তার মধ্যেই এক জন হিজাব টানা মহিলা কোথা থেকে যেন দৌড়ে এসে জাপটে ধরে যুবনেত্রীর গাল টিপে দিয়ে বললেন, ‘‘মা রে, তোর জন্য এসেছি’’। হাসিমুখে মিনাক্ষীও বললেন, ‘‘আশীর্বাদ করবেন।’’ সেই মহিলার হাতে অ্যানড্রয়েড ফোন ছিল না। পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, গ্রামের প্রান্তিক অংশের। তাই সেলফির আবদার ছিল না। তবে মিনাক্ষীকে নেমন্তন্ন করে গেলেন। বললেন, ‘‘এর পরের বার মেমারি গেলে, আমার বাড়িতে ভাত খাবি।’’ শুনে আবার হেসে ঘাড় নাড়লেন মিনাক্ষী। এক গাল হাসি নিয়ে।
নিজের বক্তৃতায় তৃণমূল, বিজেপি দুই দলকেই সমান ভাবে বিঁধেছেন মিনাক্ষী। বাংলা, হিন্দি মেলানো সাবলীল বক্তৃতায়। তবে বিপত্তি বাধিয়ে বসেন একেবারে শেষ দিকে। নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা উদ্ধৃত করতে গিয়ে লাইন গুলিয়ে ফেলেন। তার পর নিজেই বলেন, ‘‘ভুলে গেছি।’’ সে উচ্চারণে কোনও শঠতা ছিল না। মিনাক্ষীর পরে বলতে উঠে সেলিম ওই ভুল দিয়েই শুরু করেন। বলেন, ‘‘এটাই ফারাক। কেউ ডহরবাবুকে খোঁজেন। কিন্তু ভুল স্বীকার করেন না। আর মিনাক্ষী সেটা করল।’’
সভার শেষে ফের মাইক হাতে নিয়ে মিনাক্ষী কর্মীদের উদ্দেশে ঘোষণা করলেন, ‘‘মাঠকে বাঁচাতে, সবুজকে বাঁচাতে, আমাদেরই পরিষ্কার করতে হবে।’’ সবাইকে নিয়ে নিজেই নামেন ব্রিগেড পরিষ্কারে। মঞ্চ থেকে মাঠ, নেতা থেকে কর্মীর বিবিধ ভূমিকায় দেখা গেল তাঁকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy