ছেলে দুর্জয়কে ফিরে পেয়ে কান্না নমিতাদেবীর। বৃহস্পতিবার কামালগাজির ‘ইচ্ছে’ অনাথ আশ্রমে স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।
শুরুটা হয়েছিল চার বছর আগে এক উৎসবের সকালে। আর এক অগস্ট-দুপুরে সেই গল্পে ইতি পড়ল।
দুপুর ঠিক সাড়ে তিনটে। কামালগাজির ‘ইচ্ছে’ অনাথ আশ্রমে ঢুকলেন মাঝবয়সি এক মহিলা। ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে বছর পনেরোর এক কিশোর। কোনও কথা না বলে মহিলা জড়িয়ে ধরলেন ছেলেটিকে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরছে তাঁর। থম মেরে থাকা কিশোরের চোখও ছলছল। কিছু ক্ষণ পরে ছেলেটি বলে উঠল, ‘‘তোমার এমন চেহারা হয়েছে কেন, মা?’’ ছেলের কথা শুনে মুখ খুললেন মা-ও। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘চার বছর ছেলেকে ছেড়ে থাকার কষ্ট তুই কী করে বুঝবি!’’
অপেক্ষা শেষ। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের বাসিন্দা নমিতাদেবী ফিরে পেলেন চার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলে দুর্জয় ভক্তকে (বিদেশ মন্ত্রকের খাতায় পদবি ভক্তি)। মা ও ছেলের এই পুনর্মিলন দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে জল এসে গিয়েছে দুর্জয়ের এ দেশের ঠিকানা ‘ইচ্ছে’ অনাথ আশ্রমের আবাসিকদেরও।
২০১১ সালের ইদের আগের দিন উৎসব দেখতে সীমান্তের কাছে এসেছিল দুর্জয়। লুকোচুরি খেলতে খেলতে এক হুড়োহুড়িতে পড়ে সে চলে আসে এ-পার বাংলায়। সীমান্তের এ দিকে এসে প্রথমেই সে এক মাদক পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে। সেই লোকটার এবং তার পরে হাওড়ার মালিপুকুর হোমের অত্যাচার সইতে হয়েছিল তাকে।
কিছু দিন পরে হাওড়ার ওই হোম থেকে পালিয়ে সে চলে এসেছিল শিয়ালদহে। সেখান থেকে শিশুকল্যাণ সমিতির মাধ্যমে ঠাঁই পায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার কামালগাজির ‘ইচ্ছে’ অনাথ আশ্রমে। বাংলাদেশি বললে হয়তো লাঞ্ছনা জুটবে সেই ভয়ে সেখানে নিজের নাম বলেছিল, ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী।
কলকাতার হোমে আর পাঁচটা অনাথ শিশুর সঙ্গে যখন দিন গুজরান করছে দুর্জয়, তখন বাংলাদেশে নিজেদের ভিটেতে আর দিন কাটতেই চাইত না নমিতাদেবীর। তিনি বলছিলেন, ‘‘ছেলেকে ফিরে পেতে মন্দির-দরগা-জ্যোতিষী, কোথায় না গিয়েছি! শুধু ভাবতাম, বেঁচে থাকতে ছেলের মুখ আর দেখতে পাব কি না?’’ গত চার বছরে রাতের পর রাত ঘুমোতে পারতেন না। ছোট ছেলে অসুস্থ। বেসরকারি সংস্থার চাকুরে স্বামী কাজের সূত্রে অনেক সময়ই বাড়িতে থাকেন না। একহাতে বাড়ির সব কাজ সামলে বড় ছেলের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতেন নমিতাদেবী।
বছর খানেক আগে হাওড়ার এক হোমে দুর্জয় আছে বলে জানা গিয়েছিল। তা শুনে তখনই ভারতে ছুটে এসেছিলেন নমিতাদেবী। কিন্তু ছেলেকে পাননি। সেই হোম থেকে তাঁকে বলা হয়, দুর্জয় নামে সেখানে কেউ থাকে না।
বুধবার সন্ধ্যায় ভাইয়ের মুখে দুর্জয়ের খোঁজ পাওয়ার পরেও তাই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি নমিতাদেবী। সারা রাত জেগে কাটিয়ে সকালেই রওনা দিয়েছিলেন ‘ইন্ডিয়ার’ দিকে। এ বার অবশ্য খালি হাতে ফিরতে হয়নি তাঁকে।
ছেলেকে জড়িয়ে ধরে এ দিন বারবার স্বামীর কথাও বলছিলেন দুর্জয়ের মা। মামার ফোন থেকে এ দিন বাবার সঙ্গেও কথা বলেছে দুর্জয়। ফোনে বাবা-ছেলের কথোপকথন চলছে, আর পাশে নমিতাদেবী বলে চলেছেন, ‘‘৭১-এর যুদ্ধে লোকটা গোটা পরিবারকে হারিয়েছিল। সংসারে একটু সুখের মুখ দেখতে না দেখতেই হারিয়ে গিয়েছিল বড় ছেলেটা। তবু বুকে পাথর চেপে থাকত। পাছে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি।’’
মালিপুকুর হোমে থাকতেই দুর্জয়ের খবর বিদেশ মন্ত্রক মারফত গিয়েছিল বাংলাদেশে। কিন্তু সেই খবর পেয়ে যত দিনে নমিতাদেবীরা এখানে এসেছিলেন, তত দিনে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়েছে দুর্জয়। তাই সরকারি খাতায় তার ঠিকানা ওই হোম হলেও তাকে সেখানে পাওয়া যায়নি। সে কোথায়, জানাতে পারেনি প্রশাসনও।
দুর্জয়ের নিখোঁজ রহস্য বুধবারের আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘ইচ্ছে’ আশ্রমে বসে সে দিন সকালে নিজের ছোটবেলার ছবি ও খবর পড়ে চমকে গিয়েছিল দুর্জয়। আশ্রমের কর্তাদের বলেছিল, ‘‘এই ছেলেটাকে আমি চিনি। একে বাড়ি ফেরাতেই হবে।’’ তার পর বুধবার বিকেলে নিজেই শিয়ালদহ স্টেশনে এসে পরিচিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীদের নিজের কথা খুলে বলে। সেখান থেকে আনন্দবাজারের মাধ্যমেই তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় বাংলাদেশে থাকা দুর্জয়ের মামা সুব্রত মণ্ডলের।
দুর্জয়ের খোঁজে এর আগেও তাঁরা ভারতে এসেছেন বলে নমিতা-সুব্রতের পাসপোর্ট-ভিসা সব তৈরিই ছিল। এ দিন দিদির সঙ্গে ভারতে চলে এসেছেন সুব্রতও। কামালগাজির আশ্রমে বসে তিনি জানালেন, দুর্জয়কে খুঁজতে গত এক বছরে তাঁকে সাহায্য করেছেন সঞ্জীব কাঞ্জিলাল নামে হাবরার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তা। ‘‘আমরা ওঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব’’, বলছিলেন সুব্রত।
আজ, শুক্রবার কলকাতার শিশুকল্যাণ সমিতির কাছে দুর্জয়কে ফিরে পেতে আর্জি জানাবে তার পরিবার। সমিতি অনুমতি দিলেই মা-মামার হাত ধরে নিজের বাড়ি চলে যাবে সে।
দুর্জয়ের এমন আনন্দের দিনে কিছুটা মনমরা ‘ইচ্ছে’ আশ্রমের অনেকেই। আশ্রমের সম্পাদক পার্থসারথি মিত্র বলছিলেন, ‘‘ছেলেটা অন্যদের থেকে আলাদা। আমরা ওকে খুবই ভালবেসে ফেলেছিলাম।’’ রাখি পূর্ণিমার দিন আশ্রমের সব শিশুকেই রাখি পরান শর্মিষ্ঠা-অপর্ণা নামে আশ্রমের দুই তরুণী ‘দিদিমণি’। এ বছর রাখিপূর্ণিমা পর্যন্ত দুর্জয় হয়তো আশ্রমে থাকবে না। তাই এ দিনই তার হাতে রাখি বেঁধে দিয়েছেন দুই দিদি।
আশ্রমে দুর্জয়ের সঙ্গে সব সময় লেপ্টে থাকত মঙ্গল আর রাহুল নামে সব থেকে ছোট্ট দুই আবাসিক। মায়ের কোল ঘেঁষে বসে থাকা দুর্জয়দাদাকে একটু দূর থেকেই দেখছিল তারা।
দাদা চলে গেলে মন খারাপ হবে না? একটু থেমে রাহুলের উত্তর, ‘‘না। ও তো নিজের বাড়িতেই যাচ্ছে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy