ব্যস্ততা: দিল্লির কালীবাড়ি গোল মার্কেট এলাকায় চলছে শেষ মুহূর্তের তুলির টান। ছবি: প্রেম সিংহ
মেয়ের সাজ দেখো! ঠিক যেন মা-দুগ্গা। ত্রিশ ছুঁই-ছুঁইয়ের গালে ঠোনা মেরে যিনি চলে গেলেন, তাঁর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। আড়চোখে দেখলেও বেশ বোঝা যায়, ঠোনার মধ্যে কিছুটা প্রশ্রয় লুকিয়ে আছে।
উত্তর শহরতলির এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি বড় লোহার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ও-পারের কাহিনি হাত বাড়িয়ে ডেকে নেয়। দু’বছরের মেয়েকে ফেলে মায়ের চলে যাওয়া, আবার একরত্তি ভাইঝিকে বুকে আগলে রেখে মা-বাবার অভাব ভুলিয়ে দেওয়া জেগে থাকে স্মৃতি-বিস্মৃতিতে।
এমনিতে ঘড়ির কাঁটা ধরেই চলা। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, বাথরুমে যাওয়া, জলখাবার খেয়ে হালকা ব্যায়াম, দুপুরে খাওয়ার পরে বিশ্রাম বা আবাসনের লাগোয়া মাঠে ঘোরাঘুরি, সন্ধেবেলা কারও গলা সাধা, কারও নাড়ু বানাতে বসা, রাতে খেয়ে-দেয়ে ঘুম। আর ফাঁকে-ফাঁকে ওষুধ। কারও দু’বার, কারও চার বার, কারও ছ’বার। সেখানেই ছন্দ মেনে উঁকি দেয় পুজো। বাড়ি যাওয়া। মা-বাবা, ভাই-বোনদের সঙ্গে কয়েকটা ‘স্বাভাবিক’ দিন কাটিয়ে আসা।
আরও পড়ুন: আজ নজর আদালতে, মণ্ডপে বাড়তি বাহিনী, ড্রোনও
তাই কাটে বুঝি?
‘‘যদি তাই হত, তা হলে চিন্তা ছিল না,’’ আক্ষেপ করছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়। জানালেন, বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে বহু মনোরোগী বছরের পর বছর রয়ে গিয়েছেন। পুজোর সময়েও তাঁদের বাড়ি থেকে না-আসেন কেউ, না-আসে নতুন জামা। তবে সরকারি অনুদানে নতুন জামাকাপড় হয়। খাওয়াদাওয়া স্পেশাল মেনু মাফিক। বাসে করে ঠাকুর দেখা।
আশি পেরোনো সরযূ কিন্তু পুজোর সময়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা বললেই আঁকড়ে ধরেন চিকিৎসকের হাত। কাকুতি-মিনতি করতে থাকেন, ‘‘পুজোর দিনে আমায় কোথাও নিয়ে গিয়ে ফেলে আসিসনি বাবা। আমি এখানেই থাকব। তোদের একটুও জ্বালাব না।’’
নিজের নামটুকু ছাড়া আর বিশেষ কিছুই মনে নেই বৃদ্ধার। বিস্মৃতির অতল থেকে শুধু ঘাই মারে এক ‘ফেলে চলে যাওয়ার’ স্মৃতি। ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে বছর কয়েক আগে স্টেশনে সত্তরোর্ধ্ব মাকে বসিয়ে রেখে চলে গিয়েছিল ছেলে, অনুমান হাসপাতালের পুরোনো কর্মীদের।
আরও পড়ুন: হাইকোর্টের রায় মেনে বেলুড় মঠে পুজোর জায়গায় পনেরো জন
অন্য আর এক প্রত্যাখ্যানে বাস কনকাঞ্জলির। যিনি ‘দুগ্গা ঠাকুরের’ মতো সাজেন। বছর তিরিশের মেয়েটির হাবেভাবে বছর পাঁচেকের শিশুর সারল্য। ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কনকাঞ্জলির ঠিকানা উত্তর শহরতলির এক বেসরকারি মনোরোগ কেন্দ্র। হোমেরই এক চিকিৎসকের মুখে শুনলাম, মেয়েটির বছর তিনেক যখন বয়স, মা চলে গিয়েছিলেন মেয়েকে ফেলে, অন্য সংসার বাঁধতে। বছর ঘুরতে না-ঘুরতেই দুর্ঘটনায় বাবার মৃত্যু। ‘খেপি’ মেয়েটির জন্য রয়ে গেল শুধু এক চমকদার নাম, আর এক বুড়ি পিসি। তিনিই গায়ের গয়না বিক্রি করে ভাইঝিকে এই হোমে নিয়ে এসেছিলেন। আগে পারলেও এখন আর পুজোর সময়ে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন না। তাতে অবশ্য কিছু যায়-আসে না কনকের। নতুন জামা, যত্ন করে বেঁধে দেওয়া চুল আর দুই ভুরুর মাঝখানে বসিয়ে দেওয়া একটা ছোট্ট টিপ। তাতেই কনক লতার মতো জড়িয়ে ধরেন হোমের মাসিদের।
তবে সবাই তো কনক নন। পুজোর ছুটিতে বাড়ি যাব ভাবলেই মন আনমনা। কিন্তু এ বার যে বাড়ি যাওয়া অনেকেরই বন্ধ। সংক্রমণের ভয়! তাই কারও মা-বাবা পুজোর জামা দিয়ে গিয়েছেন, ছেলের প্রিয় বিস্কুট রেখে গিয়েছেন কেউ, কেউ মেয়ের জন্য দুল। ২২ বছরের সুকল্যাণ এখনও জানেন না, পুজোয় বাড়ি যাওয়া হবে না। ‘‘ওকে না-নিয়েই চলে যাচ্ছি দেখে ‘আমাকে বাবার কাছে যেতে দাও’ বলে ছটফট করছিল ছেলেটা। আর পিছনে ফিরে তাকাইনি। শুধু শুনলাম ওয়ার্ড বয় বলছে, চলো চলো, আজ মাংস রান্না হয়েছে, খাবে না?’’ হাউহাউ করে কাঁদেন সুকল্যাণের মা।
হোক না অতিমারি, হোক না ক্রান্তিকাল, তবু ছেলেকে না নিয়ে ফিরতে পারবেন? এই পুজোর সময়ে? ‘‘উপায় কী!’’ এ বার কিছুটা নিরুত্তাপ মায়ের গলা। ‘‘এঁরা বলেই দিয়েছেন, করোনা পরীক্ষা না-করে এখানে আর ফেরত আনা যাবে না। দেখেছেন, কেমন নাকে যন্ত্র ঢুকিয়ে পরীক্ষা করে! আমার ছেলেকে কেউ ছুঁতেই পারে না। ওকে কী করে এই পরীক্ষা করাব।’’ খানিক স্বগতোক্তির ভঙ্গিতেই বলে চলেন প্রৌঢ়া, ‘‘কত ছেলে তো বিদেশে থাকে। তারাও করোনার জন্য দেশে ফিরতে পারছে না। আমরাও ধরে নিয়েছি, আমাদের ছেলে সে রকমই এ বছর আর বাড়ি আসবে না।’’
খোয়া-ওঠা রাস্তা দিয়ে লাফাতে লাফাতে ফিরছে গাড়ি। হোমের লোহার গেট ক্রমশ দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে ফের ঝাপসা মায়ের চোখ— ‘‘জানেন, আমার ছেলেটা বড্ড পেঁয়াজপোস্ত খেতে ভালবাসে। ভেবেছিলাম, ষষ্ঠীর দিনই পেঁয়াজপোস্ত বানাব...!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy