কচি গাছের পাতা কুঁকড়ে যাচ্ছে ডললে খোরসানি (পাহাড়ি লঙ্কা) গাছের।
দার্জিলিঙের সহোদরা শৈলশহর কালিম্পং। গ্রীষ্মের দহনজ্বালা জুড়োতে অনেকে পাড়ি দেন সেখানেও। ওই শহরের হোটেলের ঘরে ঢুকে চমকে উঠছেন পর্যটকেরা। সিলিং থেকে ঝুলছে ফ্যান! হিমালয়ের কোলের শহর কালিম্পঙেও ফ্যান লাগে? হোটেলকর্মীরা জানান, আগে লাগত না। ইদানীং গ্রীষ্মকালে প্রয়োজন হচ্ছে।
উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু বদল যে শুধু কালিম্পংবাসীকে ফ্যানের হাওয়া খেতে বাধ্য করাচ্ছে, তা নয়, তা ঘোরতর প্রভাব ফেলছে চাষ-আবাদে, জনজীবনেও। কালিম্পঙের কৃষকেরা বলছেন, তাপমাত্রা, বৃষ্টির ধরনধারণের পরিবর্তন কয়েক বছর ধরেই চোখে পড়ছে। সেই পরিবর্তনের গোড়াতেই কমলালেবুর বাগানে কোপ পড়েছিল। ইদানীং মার খাচ্ছে আদা, ডললে খোরসানি বা পাহাড়ি লঙ্কার ফলনও।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলের অধ্যাপক সুবীর সরকার জানান, কালিম্পঙের জলবায়ু বদলের চরিত্র বুঝতে সংশ্লিষ্ট সব দিকের সবিস্তার তথ্য দরকার। এখন যা পাওয়া যাচ্ছে, তা যথেষ্ট নয়। আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে। এই প্রবীণ অধ্যাপক বলছেন, চাষ-আবাদ এবং জনজীবনে যে-বিরূপ প্রভাব পড়ছে, তার সঙ্গে জলবায়ুর চরিত্র বদলের যোগ রয়েছে।
কালিম্পঙের পুদুং গ্রামে কয়েক একর জমি আছে দীপবাহাদুর তামাংয়ের। এক কালে আদা চাষ করে ভাল লাভও করেছেন। কিন্তু এখন আর আদার চাষ করছেন না। তিনি জানান, আদা গাছের চারা বেরোনোর কিছু দিন পর থেকেই পাতা হলুদ হয়ে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে অধিকাংশ চারা। যেগুলি বাঁচছে, সেগুলিতেও ফসল তেমন হচ্ছে না। তাঁর হিসেব, দুই একর জমিতে আদাগাছ লাগাতে বীজ, মজুরি, সার-সহ সব মিলিয়ে ৮০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা খরচ। আগে এক মন আদাবীজ বসালে প্রায় দ্বিগুণ ফসল উঠত। এখন তা অনেক কমে গিয়েছে। লোকসানের ভয়ে আদা চাষ কমছে। দীপবাহাদুর এখন নির্মাণকাজের ঠিকাদারি করেন। লাভ কম হলেও পুদুং গ্রামের কেউ কেউ ধান চাষ শুরু করেছিলেন। কিন্তু এ বার বর্ষার শেষ পর্বের অতিবর্ষণে পাকা ধানগাছ ভূমিশয্যা নিয়েছে।
ওই গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা বুদ্ধ তামাং একদা ব্যাঙ্কে চাকরির সূত্রে দীর্ঘদিন হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনায় কাটিয়েছেন। ঝরঝরে বাংলায় বলেন, “এমন জোরালো বৃষ্টি বা গরম আবহাওয়া আগে সমতলে মিলত। এখন হাজির হয়েছে পাহাড়েও।”
মহাকালদাড়ার বাসিন্দা নন্দকিশোর ছেত্রী আগে প্রচুর ডললে খোরসানির চাষ করতেন। এ বারেও করেছেন। খেত ঘুরিয়ে দেখালেন, কচি কচি পাতা হলুদ হয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। ফলও তেমন ধরছে না। তিনি জানান, ইদানীং আলু চাষই বেশি লাভজনক। ডললে চাষ করতে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়েছেন অন্যেরাও। তাঁদের সব গাছের চারাই শুকিয়ে গিয়েছে।
পরিবেশবিদেরা বলছেন, শুধু কালিম্পং নয়, পরিবেশ বদলের প্রভাব পড়ছে দার্জিলিঙেও। সেখানেও কমলালেবু, আদার চাষ মার খাচ্ছে। কার্শিয়াঙের সিটংয়ের কমলালেবু এক কালে বিখ্যাত ছিল। এখন তা ছোট হয়ে যাচ্ছে, বহু লেবু কচি অবস্থাতেই খসে পড়ছে। যে-ভাবে বদল আসছে, তাতে কয়েক বছর পরে দার্জিলিঙের কমলালেবুর সুখ্যাতি আর থাকবে কি না, সন্দিহান অনেকেই। চাষিদের কারও কারও পর্যবেক্ষণ, মাটিটাই যেন নষ্ট হয়ে গিয়েছে! সেই জন্য কোনও কিছুই যেন ঠিকমতো হচ্ছে না।
চা-বাগানের লোকজন জানাচ্ছেন, আগে বর্ষায় নিয়মিত হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হত। এখন কখনও শুখা, কখনও অতিবৃষ্টি। ফলে চা গাছের ক্ষতি হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে চা উৎপাদনের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন বিজ্ঞান পত্রিকায়। তাতে বলা হয়েছে, জলবায়ু বদলের ফলে গুণে ও পরিমাণে মার খেতে পারে দার্জিলিঙের চা।
পরিবেশবিদেরা বলছেন, বদল যে হচ্ছে, জনজীবনের উপরে নানা প্রভাব থেকেই তা স্পষ্ট। পরিস্থিতি যে ক্রমশ প্রতিকূল ও বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠছে, মিলছে তার ইঙ্গিত। সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টি এই বিপদকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই বিপদ ঠেকানোর উপায় নিয়ে সরকারি স্তরে কোনও পরিকল্পনা আছে কি?
প্রশাসনিক সূত্রের বক্তব্য, এই ধরনের বদল-বৃত্তান্ত রাজ্যের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে। প্রাকৃতিক বদল হয়তো ঠেকানো যাবে না। তবে তার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। জোর দেওয়া হচ্ছে পরিবেশবান্ধব ব্যবসার উপরে, বিকল্প চাষে। কিন্তু সেই প্রয়াস কতটা প্রসার লাভ করেছে, সেই প্রশ্ন থাকছেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy