‘দুয়ারে ডাক্তার’ পরিষেবা। ফাইল চিত্র।
জয়কৃষ্ণ দেওয়ানকে এখনও ভুলে যায়নি জলপাইগুড়ি।
স্ত্রী লক্ষ্মীরানি মারা গিয়েছেন জলপাইগুড়ি মেডিক্যাল কলেজে। বাড়ি তাঁদের কিছু দূরের এক গ্রামে। সেই পর্যন্ত দেহ নিয়ে যেতে হবে। তাই হাসপাতালের গাড়িগুলির সঙ্গে দরদস্তুর করতে গিয়েছিলেন জয়কৃষ্ণ। পকেটে তাঁর ১২০০ টাকা। কিন্তু যা ভাড়া শুনলেন, তা তাঁর আয়ত্তের অনেকটাই বাইরে। শোনা যায়, শেষে স্ত্রীর দেহ কাঁধে নিয়ে তিনি এবং তাঁর ছেলে বার হয়ে পড়েছিলেন হাসপাতাল থেকে।
‘ভাইরাল’ হয়ে যাওয়া জয়কৃষ্ণদের ছবি নিশ্চয় রাজ্যের স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর জন্য ভাল বিজ্ঞাপন নয়।
অথচ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো কি তৈরি হয়নি গত এগারো বছরে? বরং জেলায় জেলায় খোঁজ নিলে দেখা যাবে, অনেক কাজই হয়েছে। একাধিক সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিকে সুস্বাস্থ্যকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা...। বালুরঘাট জেলা হাসপাতালের মধ্যেই সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। মালবাজারেও স্থানীয় মানুষ হাসপাতালটি নিয়ে কথা বলতে ভালবাসেন। নন্দীগ্রামে যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি হয়েছে, তার ভিতরে ঢুকলেও দেখা যাবে, টিভি-র স্ক্রিনে ফুটে উঠছে সেই সময়ে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের নাম।
কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে কি পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে ঠিকঠাক স্বাস্থ্য পরিষেবা? প্রশ্ন: তা হলে এত ‘রেফার’ হয় কেন কলকাতার হাসপাতালে? সেই পরিমাণ এতটাই যে, মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে হয়, ‘রেফার’ করলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন
‘দুয়ারে ডাক্তার’ পরিষেবাই বা কেন দিতে হচ্ছে সরকারকে?
নদিয়ার কথাই ধরা যাক। জেলায় এখন ৪৬৯টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। আরও ৪২১টি হওয়ার কথা। কিন্তু কর্মী নিয়োগ নিয়ে তথ্য জেলা স্বাস্থ্যকর্তারা দিতে পারছেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পঞ্চায়েতগুলি গত পাঁচ বছরে যে পরিমাণ টাকা খরচ করেছে, তার অতি সামান্যই খরচ হয়েছে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে। গড়ে ৫-৬ শতাংশ মাত্র।
‘রোগ’ শুধু একটা নয়। সেই তালিকায় আছে ১) ডাক্তার-নার্স থেকে শুরু করে সব স্তরে চিকিৎসা কর্মীর অভাব। স্বাস্থ্য দফতরের লোকেরাই জানাচ্ছেন, গ্রামে চিকিৎসার জন্য না পাওয়া যায় ডাক্তার, না থাকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স। ২) যন্ত্রপাতির অভাব। অনেক ক্ষেত্রে কোষাগারে টাকা না থাকায় যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টি ঝুলে থাকে। ৩) যন্ত্র থাকলেও তা চালানোর জন্য প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে দাবি, এমন ছবি অনেক বড় হাসপাতালেই দেখা যায়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির হাল তো আরও খারাপ। ৪) মাতৃমা কেন্দ্রে আয়াদের দাপট নিয়ে অভিযোগ। ৫) সর্বোপরি, গ্রামে চিকিৎসা করতে যাওয়ার ব্যাপারে অনীহা। জেলার স্বাস্থ্য দফতরের একাংশের দাবি, সরকারের নানা চেষ্টা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত গ্রামে গিয়ে চিকিৎসকেরা স্থায়ী ভাবে ডাক্তারি করতে চান না। উল্টো দিকে, চিকিৎসক মহল আবার জেলা, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে পরিকাঠামোর অভাবকেই দায়ী করে জানিয়েছেন, এই অবস্থায় ঠিক মতো চিকিৎসা করা কঠিন। আর অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর কিছু হলে পরিবারের রাগ গিয়ে পড়ে ডাক্তারদের উপরে।
স্বাস্থ্য নিয়ে ক্ষোভের আঁচ সম্প্রতি পেয়েছেন দুই অভিনেত্রী-জনপ্রতিনিধি। জুন মালিয়া এবং শতাব্দী রায়। মাসখানেক আগে শালবনির গোদাপিয়াশাল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিদর্শনে যান বিধায়ক জুন। তাঁকে কেউ অভিযোগ করেন, দুপুরের পরে ডাক্তার থাকে না। কারও অভিযোগ, শয্যা থাকা সত্ত্বেও রোগী ভর্তি নেওয়া হয় না। ‘দিদির দূত’ হয়ে খয়রাশোলের বড়রা গ্রামে গিয়ে স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামো ও পরিষেবা নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ শুনতে হয় সাংসদ শতাব্দী রায়কেও। রামপুরহাট মহকুমায় একটি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিয়েও অনুযোগ শুনতে হয় বিধায়ক তথা ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
জেলা এবং সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালগুলির দশাও ভাল নয় বলেই দাবি। যেমন, বনগাঁ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, সাধারণ মেডিক্যাল অফিসার, নার্স, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী— সব ক্ষেত্রে লোকাভাব। নেই এমআরআই, সিটি স্ক্যানের ব্যবস্থাও। নেই কোনও পূর্ণাঙ্গ আইসিসিইউ। মেদিনীপুর মেডিক্যাল বা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ট্রলি মেলে না অনেক সময়েই। পেতে গেলে ‘খরচ’ করতে হয়। চেয়েও মেলে না গদি। বাইরে থেকে পলিথিন শিট কিনে আনতে হয়। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, অ্যাঞ্জিওগ্রাম, স্টেন্ট-পেসমেকার বসানো— কিছুই হয় না মেদিনীপুরে। উত্তরবঙ্গের অনেক জেলাতেই হৃদ্রোগ থেকে পথ দুর্ঘটনা, নিউরো সার্জারি, কিডনির জটিল অসুখ বা ক্যানসারের মতো রোগের চিকিৎসায় রোগীদের ভরসা নার্সিংহোম, কলকাতা বা অন্যত্র ‘রেফার’।
যদি জেলা স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশের দাবি, ‘রেফার’ কমেছে। মুর্শিদাবাদের মতো তুলনায় পিছিয়ে থাকা জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সন্দীপ সান্যাল বলেন, ‘‘দু’বছর আগে যেখানে গড় রেফারেল রেট ছিল ১২ শতাংশ, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৮ শতাংশে।’’ তবে পরিষেবায় যে ঘাটতি হচ্ছে, সেটা মানছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগী বলেন, “লোক কম বলে পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে— এটা অজুহাত। যে চিকিৎসক ও কর্মীরা রয়েছেন, তাঁরা নিজেদের কাজ ঠিকমতো করলে পরিষেবা ব্যাহত হত না। কাজ ঠিকমতো করুন, যন্ত্রগুলি ব্যবহার করুন, তা হলে আর কেউ অভিযোগ করবে না।” স্বাস্থ্য অধিকর্তার আরও দাবি, “হাসপাতালগুলির মানোন্নয়ন করা হয়েছে। কিন্তু কোথাও মানবসম্পদ কমানো হয়নি।’’ এর পরেই তাঁর প্রশ্ন, ‘‘তা হলে পরিষেবায় ঘাটতি হবে কেন?’’
স্বাস্থ্যকর্তার প্রশ্নেই মালুম হচ্ছে পরিস্থিতি।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy