Advertisement
E-Paper

বহুত্ববাদের বৃক্ষ মুর্শিদাবাদ, রক্তক্ষরণ ঠেকাতে সন্দীপ-সোলেমানদের দরকার

মুর্শিদাবাদের প্রতি আমার এক অমোঘ টান, ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে এক কৃতজ্ঞতার বন্ধন। আমার আমি হয়ে ওঠার যাত্রাপথে মুর্শিদাবাদকে আমি আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে থেকেছি। মুর্শিদাবাদ এক বৃক্ষ, আমি তাঁকে জড়িয়ে থাকা লতানো গাছ।

দোস্তজী ছবির একটি দৃশ্য।

দোস্তজী ছবির একটি দৃশ্য। —ফাইল চিত্র।

প্রসূন চট্টোপাধ্যায় (দোস্তজী ছবির পরিচালক)

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৭:৫৩
Share
Save

আমি এখন কলকাতা থেকে প্রায় ৯০০০ ফুট উঁচুতে নেপাল সীমান্তের কাছে একটা প্রত্যন্ত গ্রামে আছি। ইন্টারনেট যোগাযোগ প্রায় না থাকায় সে ভাবে কোনও খবর পাচ্ছি না, তবে ‘দোস্তজী’ (দুই বালক বন্ধু পলাশ-সফিকুলের গল্প) তৈরির সূত্রে মুর্শিদাবাদ জেলায় অসংখ্য পরিচিত, বন্ধু, সাংবাদিক থাকায় তাঁদের মুখ থেকে বেশ কিছু ঘটনা, খবর শুনছি।

মুর্শিদাবাদের প্রতি আমার এক অমোঘ টান, ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে এক কৃতজ্ঞতার বন্ধন। আমার আমি হয়ে ওঠার যাত্রাপথে মুর্শিদাবাদকে আমি আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে থেকেছি। মুর্শিদাবাদ এক বৃক্ষ, আমি তাঁকে জড়িয়ে থাকা লতানো গাছ। সেই বৃক্ষে যখন কুঠারাঘাত হয়, তাঁর গা থেকে কষ গড়িয়ে পড়ে, সে রক্তাক্ত হয়, সেই সব খবরে আমি, সেই লতানো গাছটাও মানসিকভাবে রক্তাক্ত হই।

মঙ্গলবার পাহাড়ে বৃষ্টি। ঠান্ডার মধ্যে বসে উত্তপ্ত মুর্শিদাবাদের কিছু পুরনো কথা খুব মনে পড়ছে। আমাদের শুটিংয়ের মধ্যে দুটো উৎসব পড়েছিল, প্রথমে এক মাসের রমজানের পর ইদ, তারপর ঝুলন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওই দু'দিনই শুটিং বন্ধ থাকবে, সকলে মিলে আনন্দ করা হবে। হয়েওছিল তাই। আমাদের ইউনিটে অনেক স্থানীয় মানুষ ছিলেন, যাঁরা সারাদিন নির্জলা উপোস থেকে আউটডোর শুটিংয়ের ওই অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন। তাঁদেরই একজন জাহাঙ্গীর'দা; নিজে সারাদিন নির্জলা উপোস, কিন্তু প্রতি দিন আমাদের সকলকে খাওয়ানোর দায়িত্ব সামলেছেন। শুটিংয়ের চাপে মাঝে মধ্যেই আমি দুপুরের খাবার খেতে ভুলে যেতাম, সেটা যে দিন উনি বুঝতে পারেন সেই দিন থেকে রোজ হাতে খাবারের থালা নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম, কিন্তু আমাকে না খাইয়ে এক দিনও যেতেন না। বিকেল গড়িয়ে নামাজের সময় হয়ে গেলেও কখনও কখনও আমার খাওয়া হত না, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন, বলতেন, ‘‘তোমাকে না খাইয়ে নমাজে যাই কী করে বলো তো?" বাধ্য হয়েই খেয়ে নিতাম।

মোথাবাড়িতে সন্দীপ-সোলেমান।

মোথাবাড়িতে সন্দীপ-সোলেমান। — নিজস্ব চিত্র।

লাইটের টেকনিশিয়ান সঞ্জয়, খুবই ধর্মপ্রাণ। সফিকুলের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মেহেরুন্নেসা, রোজা রাখতেন। বিকেলে ওঁর ইফতারের সময়টা কিন্তু সঞ্জয়ই রোজ মনে রাখত, সেই অনুযায়ী এক ঘণ্টার বিরতি। ঝুলনের দিন স্থানীয় প্রোডাকশন কন্ট্রোলার সঞ্জীবকে আমি জাহাঙ্গীর'দার ছোট মেয়েকে সন্তানস্নেহে কোলে করে মেলায় নিয়ে যেতে দেখেছি। স্থানীয় পুরোহিত ডেকে শুটিংয়ে ব্যবহার করা কালী মূর্তির আচার অনুষ্ঠান মেনে বিসর্জনের ব্যবস্থা কিন্তু করেছিল লালন, হাসান, নূর ইসলাম, সঙ্গে লাইট টেকনিশিয়ান সঞ্জয়। এই স্বাভাবিক বিষয়গুলো যে বলতে হচ্ছে, এটাই কষ্টের। এই মুর্শিদাবাদকেই তো আমি দেখেছি। তবেও এটাও সত্যি ভিতরে ভিতরে অন্য আর একটা মুর্শিদাবাদের ভ্রূণও কিন্তু তৈরি হচ্ছিল অনেক বছর ধরেই, বিভিন্ন ছোট ছোট কিন্তু ইঙ্গিতবাহী ঘটনায় সেটাও অনুভব করতে পারছিলাম।

মঙ্গলবার আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় সন্দীপ-সোলেমানের ছবিটা দেখে ভাল লাগল, আবার অন্তত একটু ভরসা পেলাম যে, বৃক্ষ তাঁর নিজের নিয়মেই নিজের ক্ষতে প্রলেপ লাগাবে। প্রতিবেদনটির শেষে ‘দুই বন্ধু। দোস্তজী’ দেখে আবারও ভাল লাগল, কিছুটা শ্লাঘাও মিশে ছিল। বন্ধুত্বের, সম্প্রীতির সমার্থক একটা নতুন শব্দ, ‘দোস্তজী’!

তবে, এই ভাললাগা স্থায়ী হয়নি, একটু তলিয়ে ভাবলে প্রথম পাতায় ‘সন্দীপ-সোলেমানের ছবি’, ‘দুই বন্ধু, দোস্তজী’ শব্দবন্ধ; এগুলো সুখের নয়, বৃক্ষের ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা। আমাদের ছবির মূল বিষয়বস্তু এই মুহূর্তে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, ভাবলে বড্ড যন্ত্রণা হয়।

‘দোস্তজী’ তৈরির প্রতিটা মুহূর্তে এটাই চেয়েছিলাম যে আমাদের ছবির পলাশ-সফিকুলের মতন বাস্তবে সন্দীপ-সোলেমানদের অস্তিত্ব প্রকট হবে! বহুত্ববাদের বৃক্ষের রক্তক্ষরণ আটকানোর জন্য আরও বেশি সন্দীপ-সোলেমানেরই তো দরকার।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Murshidabad friendship Mothabari Hindu-Muslim Relation

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}