মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
নবান্নে বসে গত সোমবার বলেছিলেন, ‘‘পুলিশ কমিশনার অনেক বার পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। সাত দিন আগেও এসেছিলেন। সামনে পুজো। যে থাকবে, তাকে তো আইনশৃঙ্খলা জানতে হবে। কিছু দিন ধৈর্য ধরলে কী হয়!’’ পরের সোমবার রাতে কালীঘাটে দাঁড়িয়ে বললেন, কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে সরানো হচ্ছে। সঙ্গে মন্তব্য, ‘‘বিনীত যেখানে কাজ করতে চেয়ছেন, সেখানেই তাঁকে পোস্টিং দেওয়া হবে।’’ মাঝে ঠিক সাত দিনের ব্যবধান। পুজোর মুখে যে নগরপাল পরিবর্তনে আপত্তি ছিল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে সেই পদেই নতুন দায়িত্ব নিলেন মনোজ বর্মা!
পুলিশ কমিশনার এবং ডেপুটি কমিশনার (নর্থ)-এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিকর্তা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা পদেও বদল আনা হয়েছে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনার সূত্র মেনে। প্রতিবাদী চিকিৎসক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দাবি করছেন, আন্দোলনের জেরেই মাথা নোয়াতে হয়েছে রাজ্য সরকারকে। কিন্তু প্রশ্ন তাতে থামছে না। মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে এ যাবৎ অদেখা এই পশ্চাদপসরণের নেপথ্যে আন্দোলনের জোরই কি একমাত্র কারণ? পদ থেকে সরানোর যাবতীয় কারণ অনেক আগে থেকেই মজুত থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে কি আদৌ কোনও সুবিধা হল মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক দলের সর্বোচ্চ নেত্রীর? ‘সদিচ্ছা’র বদলে ‘চাপের মুখে বাধ্য হওয়া’র বার্তাই কি বেশি করে ছড়িয়ে গেল না? যা ভবিষ্যতে আরও নানা সম্ভাবনার পথ প্রশস্ত করতে পারে!
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, আর জি কর-কাণ্ডের সূত্রে টালা থানার ওসি সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরেই হাওয়া ঘুরতে শুরু করেছিল সরকারের অন্দর মহলে। বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের দিকে সিবিআই ইঙ্গিত করতে শুরু করার পরে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, এর পরে আরও উপরের দিকে টান পড়তে পারে। বড় কোনও ঘটনায় থানার ওসি স্তরের আধিকারিক যে নিজের ইচ্ছায় কাজ করেন না, শিশুও জানে! প্রশাসনের ওই সূত্রের মতে, সিবিআই তদন্তের চাপ বেড়ে যাওয়াই পুলিশ কমিশনারকে সরাতে রাজি হওয়ার নেপথ্যে মূল কারণ। সেই সূত্রই মনে করাচ্ছে, জুনিয়র ডাক্তারেরা যে দিন লালবাজারে গিয়ে পুলিশ কমিশনারের টেবিলে প্রতীকী শিরদাঁড়া রেখে এসেছিলেন, সে দিনও বিনীতকে সরানোর প্রাথমিক প্রস্তুতি হয়ে গিয়েছিল। আড়াল থেকে বিনীতের ‘রক্ষাকর্তা’ হয়ে পুলিশ-প্রশাসনের যে শীর্ষ কর্তা দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরই ‘পছন্দ’ মেনে কলকাতার নতুন পুলিশ কমিশনার হয়ে এসেছেন মারকুটে অফিসার মনোজ! বিনীতকে পাঠানো হয়েছে স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সে (এসটিএফ)। ওই শীর্ষ কর্তা, বিদায়ী এবং নবনিযুক্ত পুলিশ কমিশনারের মধ্যে যোগসূত্র হয়ে থাকছে এসটিএফ-ই।
আন্দোলনকারীরা পুলিশ ও স্বাস্থ্য-কর্তাদের অপসারণকে তাঁদের জয় হিসেবে দেখবেন, সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যে সময়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তাতে কি শাসক শিবিরের খুব সুবিধা হল? তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা কুণাল ঘোষ ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে মন্তব্য করেছেন, ‘‘ভিজ়িবল পজ়িটিভ স্টেপ্স (দৃশ্যমান সদর্থক পদক্ষেপ)। এই কথাগুলো এক জনের মুখে ক’দিন ধরে শুনেছি। তাঁর বক্তব্য ছিল, মানুষ ‘ভিজ়িবল পজ়িটিভ স্টেপ্স’ দেখতে চান। তারই প্রতিফলনে এটা বলছি। কার মুখে শুনেছি, সেটা এখন বলছি না!’’ প্রসঙ্গত, আর জি কর-কাণ্ডে গোড়া থেকে প্রশাসন যে ভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে, তাতে অসন্তুষ্ট ছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর জি করে হামলার রাতে প্রশাসনের ভূমিকায় খামতি উল্লেখ করেছিলেন, পুলিশ কমিশনারকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রং না-দেখে দোষীদের গ্রেফতারের কথাও বলেছিলেন। কিন্তু তার পরেও বিনীতকে সরানো হয়নি। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শিবিরের অনেকেরই বক্তব্য, এর পরে হাসপাতালে হামলার যথাযথ তদন্ত হলে শাসক শিবিরের পক্ষে কি খুব স্বস্তিদায়ক কিছু বেরোবে?
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পুরনো অবস্থান থেকে শেষ পর্যন্ত সরে এলেও নানা প্রশ্ন তোলার সুযোগ বিভিন্ন মহল পাচ্ছে। ‘শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী, বুদ্ধিজীবী মঞ্চে’র তরফে বিভাস চক্রবর্তী, দিলীপ চক্রবর্তীরা যেমন বলছেন, ‘‘পুলিশ ও স্বাস্থ্য দফতরের দায়িত্বে আছেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। এই সমাধান তিনি অন্তত এক মাস আগেই সেরে ফেলতে পারতেন। তার দ্বারা এক দিকে যেমন রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা বোঝানো যেত, তেমনই গরিব বা মধ্যবিত্ত সাধারণ রোগীদের এত দীর্ঘ সময় ভোগান্তি হত না!’’
বিরোধীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, যাঁদের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ, তাঁদের ‘সম্মানজনক পুনর্বাসন’ দেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কই? বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, ‘‘বিনীতকে জেলে দেখতে চাই! মুখ্যমন্ত্রী কাউকে শাস্তি নয়, ‘প্রাইজ় পোস্টিং’ দিয়েছেন। স্বাস্থ্য সচিব-সহ তিন জনকে ডিমোশন দেননি, তাঁদের প্রোমোশন দিয়েছেন।’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, ‘‘নাছোড় আন্দোলনের ধাক্কায় মুখ্যমন্ত্রী অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু পদক্ষেপ করেছেন। কিন্তু কসমেটিক সার্জারি হয়েছে, মূল রোগ নিরাময়ের কী হবে? আবার বলছি, তদন্ত চলাকালীন পুলিশ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া উচিত মুখ্যমন্ত্রীর।’’ সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীরও দাবি, ‘‘স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য ও পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগকেও নিশ্চিত করতে হবে।’’
গোটা ঘটনাপ্রবাহে শাসক শিবিরের এক নেতার উক্তি, ‘‘সুযোগ আগেই ছিল। আমরা জল ঘোলা করে খেলাম, তেষ্টাও মিটল না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy