রাজনীতির চাপান-উতোরের আবহে নিঃশব্দে একটি কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। আজ, বৃহস্পতিবার সহ-উপাচার্য অমিতাভ দত্তের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিনিধিদল বেঙ্গালুরুতে যাবে। এ দেশের বিজ্ঞান গবেষণায় অগ্রণী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পরীক্ষার শেষ ধাপে লড়তে নামছে যাদবপুর।
সম্ভাব্য রিসার্চ হাব বা গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে এ দেশের ৩২টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিয়েছে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রক। রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র যাদবপুরই এ লড়াইয়ের শরিক। সে-দিক দিয়ে জাতীয় মঞ্চে মর্যাদার এই সুযোগের জন্য যাদবপুর এখন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিও। তার আগে রাজনৈতিক চাপান-উতোরে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে অনেকেই ব্যথিত।
বেঙ্গালুরুতে গবেষণা প্রকল্প বিষয়ক উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে যাদবপুরকে দরকারি তহবিল ‘ছিনিয়ে’ আনতে হবে। রিসার্চ হাব বা কেন্দ্র হিসেবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে রেখে তার সঙ্গী ‘স্পোক’ হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়,
সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়, এনআইটি মেঘালয় এবং সিকিম বিশ্ববিদ্যালয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। অ্যাডভান্সড মেটিরিয়াল, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং এনভায়রনমেন্টাল সাসটেনিবিলিটি— এই তিনটি বিষয়ে গবেষণার জন্য যাদবপুর প্রস্তাব জমা দেবে। এই গুরুত্বপূর্ণ সফরের প্রাক্কালে যাদবপুরের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য, পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক পার্থপ্রতিম রায় বলছিলেন, “যাদবপুরের জন্য সামনের ক’টা দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়কে বার বার নিজেদের প্রমাণ করে গবেষণা তথা পঠনপাঠনের নানা পরিকাঠামো অর্জন করতে হয়।” তার পরেই তাঁর আফসোস, “অথচ নানা ধরনের অনভিপ্রেত প্ররোচনায় যাদবপুরকেই ভুগতে হয় বা যাদবপুরের ভাবমূর্তি খারাপ হয়।”
যাদবপুরের পরিস্থিতি এ দিনও কার্যত একই রকম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গোলমাল এবং শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর গাড়িতে ছাত্র আহত হওয়ার ঘটনায় যাদবপুর কর্তৃপক্ষকে এফআইআর করতে হবে বলে দাবিতে অনড় ঐক্যবদ্ধ ছাত্রসমাজ। অন্তর্বর্তী উপাচার্য ভাস্কর গুপ্তকে এসে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে বলে ছাত্রছাত্রীরা দাবি তুললেও এ দিন সকালে অসুস্থ অবস্থায় ভাস্কর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ই এম বাইপাসের ধারের বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যান শিক্ষামন্ত্রী। অন্তর্বর্তী উপাচার্যকে নিগ্রহ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অপমান করা হয়েছে বলে জানিয়ে ব্রাত্য বলেন, “ওঁর শরীর ভাল নেই। সব পক্ষকে মানবিক হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (জুটা) ডাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, আধিকারিক, গবেষক প্রমুখ অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করার প্রতিবাদে মিছিলে যোগ দেন। শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ির ধাক্কায় আহত প্রথম বর্ষের ছাত্র ইন্দ্রানুজ রায়ের বাবা অমিত রায়ও সেই মিছিলে ছিলেন। মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে শিক্ষকেরা বলছিলেন, এক দিকে রাজ্য সরকারের ব্যয় সঙ্কোচের ফলে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামো বা ল্যাবরেটরির সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা হচ্ছে। যাদবপুরের নিরাপত্তা থেকে শুরু করে কর্মসমিতি বা কোর্ট কাউন্সিলে নির্বাচিত প্রতিনিধি না-থাকাতেও সমস্যা হচ্ছে। অথচ, নানা ভাবে যাদবপুরকে রাজনীতির আখড়া করার চেষ্টা চলছে। শিক্ষামন্ত্রীর অসংবেদনশীল ভূমিকাতেও পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। এ দিনই ব্রাত্য বলেন, “যে রাজনৈতিক দল শূন্য থেকে মহাশূন্যে যাচ্ছে, তারা ছাড়া সবাই আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, তার নিন্দা করছে। যাদবপুরে উপাচার্যকে আইসিইউ থেকে উঠে বৈঠক করতে বলা হচ্ছে। যাদবপুরে অসম্ভব অসহিষ্ণুতা, নৈরাজ্য চলছে। যাদবপুর একটা দুর্গের মতো হয়ে আছে।”
ব্রাত্য আরও জানান, যাদবপুরের অন্তর্বর্তী উপাচার্যের হৃদ্যন্ত্র দুর্বল। জুটার তরফেও তিন জন শিক্ষক এ দিন ভাস্করের সঙ্গে দেখা করে, কথা বলেন। ভাস্করের স্ত্রী কেয়া গুপ্তও ছাত্রদের কাছে সহমর্মিতার আর্জি জানান। হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ভাস্কর উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন। তাঁর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ইতিহাস আছে। তাঁর জন্য কোনও উত্তেজনা ক্ষতিকর হতে পারে। সেরে উঠতে ১০-১৫ দিন লাগতে পারে।
এ রাজ্যের প্রাক্তন এবং বর্তমান উপাচার্যদের তরফেও এ দিন ব্রাত্যের গাড়িতে হামলা, ভাস্কর ও যাদবপুরের প্রবীণ শিক্ষক ওমপ্রকাশ মিশ্রের হেনস্থার নিন্দা করা হয়। শিবাজিপ্রতিম বসু, আশুতোষ ঘোষ, রঞ্জন চক্রবর্তী, দীপক কর তাঁদের মধ্যে রয়েছেন।
অন্তর্বর্তী উপাচার্যের সঙ্গে কথা না-হওয়ায় যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের তরফে আন্দোলন আপাতত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। ক্লাস, পঠনপাঠনের কর্মসূচি বিক্ষিপ্ত ভাবে চললেও তা নথিভুক্ত করা হচ্ছে না। শাসক দল ঘনিষ্ঠ ওয়েবকুপার সদস্য শিক্ষকদের ক্লাস করা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের একাংশ গররাজি। তাতে সায় নেই জুটার। এ দিন সন্ধ্যায় শিক্ষাবন্ধু সমিতির দফতর ভাঙচুরে অভিযুক্ত পুলিশি হেফাজতে থাকা মহম্মদ সাহিল আলির বিষয়ে কিছু গুজব ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায়। সাহিলের বাবা নৌশাদ আলি বলেন, “ছেলের খবর না পেয়ে আমরা খুব চিন্তায়। আমরা গোটা পরিবার তৃণমূল করি। ছেলের সঙ্গে এমন ঘটবে, কখনও ভাবিনি।” পরে সাহিল কেমন আছেন জানতে ছাত্রেরা যাদবপুর থানায় ভিড় করেন।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)