তেনজিং নোরগে টার্মিনাসের বেহাল দশা। ছবি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক।
পানীয় জলের জন্য ট্যাপ একটি লোহার খাঁচার ভিতরে। এলাকাটি জল, কাদায় সারা ক্ষণ ভরে থাকে। অপরিস্কার।
আলো পর্যাপ্ত নয়। রাতের বেলা বেসরকারি বাসের এলাকা, চত্বরের একাংশ, গেটগুলির কিছু কিছু অংশ অন্ধকারে ডুবে থাকে। কে আসছে কে যাচ্ছে, কেউ খবর রাখে না।
ক্যান্টিন দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ। যাত্রী থেকে বাসকর্মী সকলকেই জংশন এলাকার হোটেলে যেতে হয়। নইলে ভিতরে চারটি দোকান থেকে চা, কফি, বিস্কুট, কেক খেয়ে থাকতে হয়।
দোতলায় যাত্রীনিবাস রয়েছে। অর্ধেকটা পরিবহণ দফতর অফিস করে রেখেছে। বাকিটা জীর্ণ। থাকার উপযুক্ত নয়। দীর্ঘ যাত্রার পরেও চালক, কন্ডাক্টরেরা সেখানে থাকতে চান না। জংশন এলাকার হোটেলই ভরসা।
দিনভর যে দিকে চোখ যায়, গাছের তলা থেকে জেনারেটর রুমের পাশ, গেটের পাশের ফেন্সিং থেকে খোলা নর্দমা, আবার গেটের পাশেও সর্বত্র দেদার লোকজন মূত্র ত্যাগ করছেন। কোনও বাধা নেই, নিয়ম নেই। কোথাও কোথাও এমন অবস্থা, নোংরা জল বাসের ট্যারমাক অবধি পৌঁছচ্ছে।
চুম্বকে এই হল উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় সরকারি বাস টার্মিনাস শিলিগুড়ির তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ডের হাল। যেখানে রোজ বাস ধরতে যান হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। এনবিএসটিসি সূত্রের খবর, বাম আমলে এটির উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন পরিবহণ মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তী। পরে ধীরে ধীরে তা বড় হলেও পরিষেবার উন্নতি হয়নি। বাস ও রুটের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি কর্মী সংখ্যা। আয়ের রাস্তা বলতে বেসরকারি বাসের পার্কিং ফি বাবদ মাসে লক্ষাধিক টাকা। সেখানে হিলকার্ট রোডের দিকে অব্যবহৃত জমিতে মার্কেট কমপ্লেক্স, হোটেল, রেস্তোরাঁ, অফিসঘর বানিয়ে ভাড়া বা লিজে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কেবল আলোচনাই হয়েছে। আয় বাড়াতে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের এটিএম কাউন্টার করার সিদ্ধান্তও বাস্তবায়িত হয়নি।
নর্থবেঙ্গল প্যাসেঞ্জার ট্রান্সপোর্ট ওনার্স কো-অর্ডিনেশন কমিটির সম্পাদক প্রণব মানি বলেন, ‘‘টার্মিনাসটি খুবই নোংরা। বিশেষ করে আমাদের দিকে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা একেবারেই ভাল নয়। নজরদারি নেই বললেই চলে। খোলা বিরাট নর্দমা রয়েছে। রাতের দিকে আলোও কম।’’ তিনি জানাচ্ছেন, মূল গেট ব্যবহারই হয় না। সরকারি বাস বার হওয়ার গেটই মূল গেট হয়ে গিয়েছে। সারা ক্ষণ তা খোলা থাকে। লোকজন, বাস, অটো, রিকশা এর সামনে ভিড় করে থাকে। তাঁর কথায়, ‘‘যে কোনও সময় দুর্ঘটনা হতে পারে।’’
ক্ষুব্ধ নিত্যযাত্রীরাও। বাসিন্দা ও যাত্রীদের একাংশ জানিয়েছেন, রাত ১১টার পর টার্মিনাসে মধ্যে থাকলে ১০ টাকার টিকিট কাটার নিয়ম রয়েছে। টার্মিনাসের ভিতরের চত্বরের একাংশ বাইক, সাইকেলের স্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে। যত্রতত্র মালপত্র, বস্তা ভরিয়ে রাখা হচ্ছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে এনবিএসটিসি’র পযর্টন শাখার দফতর টার্মিনাসে খোলা হলেও তা বন্ধই থাকে।
বেসরকারি সংস্থার কর্মী দেবু বিশ্বাস কাজের সূত্রে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা, বর্ধমান, সিকিম যান। তাঁর বক্তব্য, ‘‘নানা রকম বাস ছাড়ে এই টার্মিনাস থেকে। কোন বাস কখন ছাড়ছে তা দেখার জন্য রেলস্টেশনে যেমন থাকে, তেমন বড় একটি ডিসপ্লে বোর্ড রাখা দরকার।’’ তাঁর দাবি, অনেক সময় কাউন্টারে লোকজনকে পাওয়া যায় না। যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য নেই বললেই চলে। যেটুকু রয়েছে তার রক্ষণাবেক্ষণ খুব খারাপ।
তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাস
উদ্বোধন-১৯৯০ সালে মার্চ।
এলাকা- তিন একর।
রুট- কলকাতা, ঝাড়খন্ড-সহ গোটা উত্তরবঙ্গের প্রায় ৮০টি রুট।
বাসের সংখ্যা- পুরানো-৫৯। জেএনইউআরএম-১২৭।
কর্মী- ২৫ জন।
পরিষেবা বন্ধ- গুয়াহাটি, তেজপুর, ছাপড়া, দ্বারভাঙা এবং পটনা।
ক্যান্টিন বন্ধ- ১০ বছর।
যাত্রী নিবাস- খাতায় কলমে চালু। কর্মীরা ব্যবহার করেন।
স্কুল শিক্ষিকা সন্তোষী অগ্রবালের বাড়ি বালুরঘাটে। প্রায়ই শিলিগুড়ি যাতায়াত করেন। তাঁর কথায়, ‘‘কিছু কিছু এলাকায় নোংরা, গন্ধে গা গুলিয়ে যায়। কর্মীদের একাংশের ব্যবহার ভাল নয়। রাতে বেলার নিরাপত্তা বাড়ানো দরকার। বসার জায়গাগুলিতে মালপত্র রাখা হয়। অনেক সময় সেখানে লোকে ঘুমিয়ে থাকে। কেউ দেখার নেই।’’
তবে সব থেকে বড় ভয়ের কথা হল নিরাপত্তার অভাব। খাতায়-কলমে ১১ জন নিরাপত্তারক্ষী রয়েছেন। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। সিটুর নর্থবেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তুফান ভট্টাচার্য জানান, টার্মিনাসটি নোংরা, অপরিষ্কার শুধু নয়, নিরাপত্তা বা নজরদারির কোনও বালাই নেই। তিনি বলেন, ‘‘১১ জন লোক দিয়ে ২৪ ঘন্টার তিনটি শিফট হচ্ছে। ৮ ঘন্টায় ৩ জন থাকেন। কম করে প্রতি শিফটে ১০ জন নিরাপত্তা কর্মী প্রয়োজন। হাজার হাজার লোক ঢোকেন প্রতিদিন। কোনও সিসিটিভি নেই। আর কর্মীদের থাকার জায়গা নিয়ে যত কম বলা হয় ততই ভাল।’’ ইনটাকের নর্থবেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের বিভাগীয় সম্পাদক প্রবীণ বোস জানান, বাস বাড়লেও যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য তলানিতে। তাঁর কথায়, ‘‘কিন্তু সব থেকে বড় প্রশ্ন নিরাপত্তার। কোনও নজরদারি নেই। দালাল চক্র ঘুরে বেড়ায়। কিছু সংস্কার হচ্ছে। কিন্তু গেটগুলি সব সময় খোলা থাকে।’’
তৃণমূলের এনবিএসটিসি-র ড্রাইভার্স এবং শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বিশ্বাস অবশ্য জানিয়েছেন, ‘‘নজরদারি বাড়ানোর জন্য আমরা ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আগের তুলনায় পরিস্থিতি অনেক ভাল হয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আরও বাড়ানো হবে বলে শুনেছি। সরকার একাধিক কাজে উদ্যোগী হচ্ছে।’’
এনবিএসটিসি-র চেয়ারম্যান সৌরভ চক্রবর্তী থেকে শুরু করে ম্যানেজিং ডিরেক্টর সুবলচন্দ্র রায় বাসস্ট্যান্ডের এই বেহাল দশার কথা জানেন। সৌরভবাবু বলেন, ‘‘টার্মিনাসে পরিষেবা বাড়াতেই হবে। অফিসারদের সঙ্গে কথা বলছি। কিছু দিনের মধ্যে টার্মিনাসের ভোল পাল্টানো হবে।’’ এমডি সুবলবাবুর কথায়, ‘‘কিছু কিছু বিষয় সত্যিই দৃষ্টিকটু। শৌচাগার থাকার পরেও যা হচ্ছে তাতে সচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন আসবেই। নিরাপত্তা রক্ষী বা সাফাই কর্মীদের নজরদারি বাড়তে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy