ভরদুপুরেও আগে ভরা থাকত। এখন এমনই ফাঁকা ঝাঝাঙ্গির ধাবা। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।
খাওয়া কমে গিয়েছে সুখদেব সিংহের। ইয়াব্বড় চেহারা আর মাথায় মস্ত পাগড়ি নিয়ে সুখদেব ধাবায় ঢুকলে কিছু বলতে হতো না। খাটিয়া টেনে বসলেই এসে যেত ছ-ছ’টা মোটা রুটি, পাঁচটি ডিম ভেঙে বানানো দেড় প্লেট তড়কা! শেষ পাতে আচার। এখন সেই সুখদেবই রুটির সঙ্গে এক প্লেট নিরামিষ তড়কা আর আচারেই সুখী। তড়কার পরিমাণ কমেছে, উধাও ডিমও!
‘‘ওজন কমাচ্ছেন নাকি?’’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন সর্দারজি। ‘‘মজাক কিঁউ করতা? নোটবন্দিকা কা এফেক্ট হ্যায় দাদা!’’ রুটিতে আচার মেখে মুখে তুলে জানালেন, অসম থেকে চা পাতা দিল্লি পৌঁছে দেওয়ার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবেন। কিন্তু এজেন্ট ৪৫ হাজার টাকা ব্যাঙ্কে জমা দেবে। তাই বাধ্য হয়েই নগদ বাঁচাতে খাওয়া কমাতে হয়েছে। সুখদেবের এই একটা ঘটনাই জানান দিচ্ছে জলপাইগুড়ির বিখ্যাত ঝাঝাঙ্গির ধাবার অবস্থাটা।
উত্তরবঙ্গের রাস্তায় নিয়মিত যাতায়াত আছে এমন সকলের মুখেই শোনা যায় রসিকতা, ঝাঝাঙ্গির ধাবার উনুন নাকি রাবণের চিতার মতো। নিঝুম দুপুর হোক বা নিশুতি রাত, সেই উনুন নেভে না। ময়নাগুড়ি ছাড়িয়ে ৩১ডি জাতীয় সড়ক ধরে কিলোমিটার পাঁচেক এগোলেই রাস্তার বাঁ দিকে ধাবাটি। পেছন দিয়ে বয়েছে ঝাঝাঙ্গি নদী। আশির দশকে ধাবা তৈরির সময় নামকরণ হয় এই নদীর নামেই। ঢুকলেই দেখা যেত পেল্লায় পাঁচটি চুল্লির কোনওটায় জাম্বো গামলায় তড়কার ডাল ফুটছে। কোনওটায় পাতিয়ালা গামলায় দুধ জ্বাল হচ্ছে। দিন হোক বা রাত, খাটিয়াতে বসে কেউ হাঁক পাড়ছেন মালাই-সহ দুধের গ্লাসের, কেউ বা মাখন ছড়ানো স্পেশাল তড়কার অপেক্ষায়। মোদী সরকারের নোট বাতিলের ধাক্কায় তা আপাতত উধাও। বেশির ভাগ সময়েই বন্ধ তিনটি উনুন।
‘‘কেন হবে না? নগদের অভাবে শখ-আহ্লাদ ছুটেছে সকলের।’’ রাস্তার দিকে খদ্দেরের পথে চেয়ে চেয়ে বিড়বিড় করলেন কাউন্টারে বসা দীপক চৌধুরী। সাধারণ দিনে দুপুরে টাকা নিয়ে খুচরো ফেরত দিতে দিতে দম ফেলার ফুসরত পান না দীপকবাবু। এখন তাঁর মাছি তাড়ানোর দশা। বেজার মুখে বললেন, ‘‘ট্রাকের কর্মীরা তো এক থালা ভাত নিয়ে দুজনে খাচ্ছেন।’’ তেমনই দু’জন, মনোজ শর্মা এবং দীনু গাইতের দেখা মিলল খানিক পরেই। মনোজের কথায়, ‘‘আলাদা থালা নিলে ১২০ টাকা পড়ত। এতে ৭০ টাকায় হয়ে গেল। মালিক টাকা দিতে পারছে না। তাই এমন করেই চালাতে হচ্ছে।’’
প্রায় ছ’একর জায়গা নিয়ে ধাবা চত্বর। ভিনরাজ্যের ট্রাক চালকদের সঙ্গে খাদ্যরসিক পর্যটকদেরও চেনা ঠিকানা এই ধাবা। স্থানীয়রা বলে থাকেন, রাত তিনটের সময়েও খাটিয়া খালি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এখন সেই ধাবাতেই ভরদুপুরে খাটিয়া উল্টে রাখা। অনেক ট্রাক চালক শুধু জিরিয়েই চলে যাচ্ছেন। যেমন হরিয়ানার বলবন্ত জাঠ। রাজস্থান থেকে কাঠের জিনিস নিয়ে অসম যাচ্ছেন। বললেন, ‘‘ট্রাক ফেলে তো এটিএমে লাইন দিতে পারব না। নিজেরাই ট্রাক থামিয়ে স্টোভে রান্না করে খাচ্ছি। তাতেও লাইনে দাঁড়ানোর থেকে সময় কম লাগছে।’’
ব্যবসা কত কমেছে তা কর্তৃপক্ষ সরাসরি না বললেও জানা গেল, ব্যাঙ্কে জমা রাখতে আগে রোজ সকালে ধাবা থেকে ব্যাগে পুরে টাকা নিয়ে যাওয়া হতো। এখন দু’দিনে এক বার ব্যাঙ্কে টাকা যাচ্ছে। স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে ৮০ জন কর্মী দিনে-রাতের শিফটে কাজ করেন। তবে ক’দিন হল অনেককেই নতুন করে কাজে নেওয়া হচ্ছে না। কর্মীদের আশঙ্কা, এ বার না ছাঁটাই শুরু হয়। সামনের পানের দোকানের কর্মী রনি সরকারও এক সুরে বললেন, ‘‘ব্যবসা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে।’’
ধাবার পাশ দিয়ে যাওয়া জাতীয় সড়ক কদিন পরেই সম্প্রসারিত হয়ে পূর্ব-পশ্চিম করিডর হবে। গুজরাতের সঙ্গে অসমের শিলচরকে সরাসরি সড়ক পথে যুক্ত করবে। সে সব ভবিষ্যতের কথা। আপাতত ছাঁটাইয়ের আশঙ্কায় উদ্বেগে ধাবার কর্মীরা। আশঙ্কাটা যে মিথ্যে নয় তা ধরা পড়ল ধাবার সামনে বছর দশেক ধরে ভিক্ষে করে আসা কাঞ্চনবালা সরকারের কথায়। সত্তর ছোঁয়া বৃদ্ধা বললেন, ‘‘আগে রোজ অন্তত দেড়শো টাকা জুটতই। এখন ৫০ টাকার বেশি আয় নেই। ভাবছি কোনও মন্দিরের সামনে গিয়ে বসব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy