স্মৃতি: একটি অনুষ্ঠানে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেবুপ্রসাদ রায় (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়)। রাষ্ট্রপতি ভবনে দু’জনের সাক্ষাৎ (ডান দিকে)। ছবি দেবুপ্রসাদ রায়ের সংগ্রহ থেকে
সালটা ১৯৮৬-’৮৭। জঙ্গলের পথ ধরে এগোচ্ছে জিপ। আচমকাই হেডলাইট কেটে গেল। অন্ধকার রাস্তায় গাড়ি এগোবে কী করে? নির্দেশ এল, ‘‘ব্যাগে টর্চ আছে। বার কর।’’ অনেক হাতড়েও খুঁজে না-পেয়ে বকুনি খেতে হয়েছিল ‘সাহেব’-এর কাছে। শেষে টর্চ জ্বেলে গাড়ি এগোচ্ছিল জঙ্গলের পথে। সেই সময়ে দূরে যাত্রার আলো দেখতে পেয়ে সেখান থেকে এক ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে ডেকে এনে হেডলাইট মেরামত করিয়েছিলেন বছর তিরিশের যুবক।
শীতের মধ্যে জঙ্গলের রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আচমকা নেমে যাওয়ায় রেগে গিয়ে সাহেব অন্যদের বলেছিলেন ‘‘ছোঁড়াটা গেল কোথায়? যত পাকামো!’’ পরে অবশ্য সকলের কাছে তাঁর বুদ্ধির প্রশংসাও করেছিলেন। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সাহেব তথা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে থাকার স্মৃতিগুলি আজও টাটকা সাতান্ন বছরের দেবুপ্রসাদ রায়ের মনে। বললেন, ‘‘উনি আমার কাছে ভগবান। ভালবেসে মাঝেমধ্যেই ছোঁড়া বলে ডাকতেন। সব স্মৃতি! বলে শেষ হবে না।’’
প্রণববাবু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই মনটা ভাল ছিল না দেবুপ্রসাদের। সাহেবের মঙ্গল কামনায় যজ্ঞও করেছিলেন। কিন্তু সোমবার বিকেলে টিভিতে খবরটা শোনার পরেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, এক সময়ের বডি-বিল্ডার দেবুপ্রসাদের। বললেন, ‘‘সকাল থেকেই মনটা কেমন উসখুস করছিল। কিছু ভাল লাগছিল না।’’ জানালেন, ১৯৮৫ সালে প্রণববাবু তখন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে কয়েক জনকে পাঠানো হল তাঁর দেখভালের জন্য। সেই দলেই ছিলেন বালি ঘোষপাড়ার দেবুপ্রসাদ। বললেন, ‘‘১৯৮৬ সাল নাগাদ উনি প্রদেশ কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমরাও বসে গেলাম। এক দিন ওই সংস্থা থেকেই আমাকে চিঠি লিখে ফের ওঁর কাছে পাঠানো হল।’’ প্রণববাবুর সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গিয়ে সেই চিঠি দেখাতেই সে দিন থেকে কাজে বহাল হয়েছিলেন দেবুপ্রসাদ। সেই শুরু। এর পর থেকে কলকাতায় এলেই ডাক পড়ত ছায়াসঙ্গী দেবুর।
আরও পড়ুন: তিনি না-থাকলে পরমাণু চুক্তিই সম্ভব হত না
গাড়িতে সামনের আসনে বসা প্রণববাবু আর পিছনে বসা দেবুর মধ্যে বিভিন্ন কথার ফাঁকে মাঝেমধ্যে রাজনীতি নিয়েও আলোচনা হত। কান্না চেপে বললেন, ‘‘ফাইফরমাশ খাটলেও কোনও দিন কাজের লোক বলে ভাবেননি। এখনও প্রতি মাসে বেতন পাঠাতেন।’’ দেবুও অপেক্ষা করতেন, কবে দিল্লি থেকে আসবেন সাহেব। তার পরেই তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে তিনিও যেতেন সর্বত্র। সময় মতো ওষুধ দেওয়া থেকে শুরু করে সার্কিট হাউস বা হোটেলে প্রণববাবুর জন্য কী রান্না হবে বা তিনি কোথায় শোবেন— সব কিছুই ঠিক করতেন দেবু। পোস্ত, ডাল, পোস্তর বড়া, ছোট মাছ আর শেষ পাতে অন্তত একটা মিষ্টি ছিল প্রণববাবুর পছন্দের খাবার। প্রতিদিন বিকেলে খেতেন শশা ও মুড়ি। শনিবার রাতে খেতেন ভাত আর আনাজ সেদ্ধ। তাঁর সব কিছু দেবুর দায়িত্বে থাকলেও নিরাপত্তারক্ষীদের খাওয়া ও থাকার ব্যাপারে সব সময়ে নিজে খেয়াল রাখতেন প্রণববাবু।
আরও পড়ুন: ভদ্রবিলার খবর জানতে চাইতেন, বাংলাদেশেরও
ঘরের দেওয়ালে টাঙানো সাহেবের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন ছবি। তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পরে প্রণববাবু এসে যে সোফায় বসেছিলেন, আজও সেটি রেখে দিয়েছেন দেবু। এ দিন বিছানায় নামিয়ে রেখেছিলেন প্রণববাবুর সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন মুহূর্তের ছবিগুলি। তারই একটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘‘ফের পিতৃহারা হলাম বলতে পারেন। খুব বিশ্বাস করতেন। কোথাও টাকা দিতে হলে সেটাও আমিই সাহেবের ব্যাগ থেকে বার করে দিতাম।’’
এক বার দার্জিলিং মেলে চেপে প্রণববাবুর সঙ্গে উত্তরবঙ্গে যাচ্ছিলেন দেবু। মচকে গিয়ে সাহেবের পায়ে চোট লেগেছে জানতে পেরে ট্রেনেই মাসাজ দিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলেন। আবার জঙ্গিপুরে নির্বাচনী প্রচার শেষে পা ফুলে গেলে দেবুর পরামর্শে গরম জলে পা ডুবিয়ে আরাম পেতেন প্রণববাবু।
ছায়াসঙ্গী, তাই ‘মুড’ বুঝতেন সাহেবের। সকালে খবরের কাগজ পড়া বা লেখালেখির সময়ে বিরক্ত করা পছন্দ করতেন না প্রণববাবু। রাতে খাওয়ার পরে ডায়েরি লিখতেন, বই পড়তেন। রাত দুটো-আড়াইটে নাগাদ ঘুমোতে যাওয়ার আগে ডাক আসত দেবুর। সব কিছু ঠিকঠাক করে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে আসতেন। সাহেবের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে দেখা করতে গিয়েও তেমনই ডাক এসেছিল। যা আজও স্বপ্ন দেবুর কাছে। বললেন, ‘‘আচমকাই এক অফিসার এসে ডেকে নিয়ে গেলেন রাষ্ট্রপতির শোয়ার ঘরে। যেতেই সাহেব হেসে বললেন, কী রে, একটু মাসাজ করে দিবি নাকি।’’
স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় বালিতে ফিরে আসতে হয়েছিল দেবুকে। আর যাওয়া হয়নি। কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘‘ছোঁড়াটা কোথায় গেল, বলে আমাকে আর কেউ খুঁজবেন না!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy