জহর গঙ্গোপাধ্যায়।
কেউ বলছেন, এ কালে গাইতে হলে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সেই পুরাতনী গান বেবাক পাল্টে যেত। শহরের ‘বাবুগিরি’র বদলে উঠে আসত, দাদাগিরির ফিরিস্তি। যেমন, ‘শহরের দাদাগিরি সবার টেক্কা দেখব ভাই/ দাদার দাদা সেরা দাদা দাদাগিরির জুড়ি নেই।’
অনেকেরই ধারণা, এ যুগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও তথাকথিত সম্ভ্রান্ত, ভদ্রজন চরিত লিখতে বাবু নয়, দাদা-মহিমায় ডুব দিতে হত। বঙ্গীয় সমাজের মাতব্বরমাত্রেই ক্রমশ বাবু থেকে ‘দাদা’ত্বে উত্তরণ লাভ করেছেন। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় তো সে-দিনের ছেলে! বাদ পড়ছেন না অতীতের মনীষীকুল। কী জাদু দাদা নামে! দিদির দাপট ফিকে হয়নি। তবু দিকে দিকে ‘আমরা দাদার অনুগামী’ বলেও পোস্টার পড়ছে।
দাদা-মহিমার টাটকা অভিজ্ঞতা, সাবেক বাংলা ছবির বিশিষ্ট অভিনেতা জহর গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘিরে। অর্ধ শতক আগে প্রয়াত, তাঁর দাদুর খোঁজে বাড়ি এসে কেউ ‘জহরদা আছেন’ বলে হাঁক পাড়বেন, তা কল্পনার অতীত ছিল জহরবাবুর নাতনি সুজাতা খাস্তগীরের কাছে। বিজেপির রক্তদান-শিবিরের জন্য ৫০ বছর আগে মৃত অভিনেতাকে অতিথি হিসেবে পেতে এমন নিমন্ত্রণের ছিরি নিয়ে অনেকেই কৌতুকমুখর। দাদা তা-ও দাদুকেও বলা যায। নাট্যকর্মী, রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু হাসছেন, “বাঙালিকে তৈরি থাকতে হবে, কোনও দিন হয়তো বা ছবি বিশ্বাস, নৃপতি চট্টাপাধ্যায় বা তুলসী চক্রবর্তীর বাড়ি গিয়েও ছবিদা, নৃপতিদা বা তুলসীদাকে ডাকাডাকি করে কোনও কর্মসূচিতে নিয়ে যেতে টানাটানি চলবে।”
এই দাদাতন্ত্র নিয়ে বাঙালির সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা সত্যিই বিচিত্র। বছর তিনেক আগে সুভাষচন্দ্র বসুর বাড়িতে পর্যন্ত চড়াও হয়ে এক তোলাবাজ-গোষ্ঠী বেমক্কা ‘তা হলে সুভাষদাকেই ডাকুন’ বলে বসেছিল। অর্থনীতিবিদ সৌরীন ভট্টাচার্য এ সব বিক্ষিপ্ত ঘটনাকে একটি সার্বিক প্রবণতা বলেই দেখছেন। তাঁর কথায়, “বাঙালি ধন্য, গুরুগম্ভীর আলোচনায় যে কেউ সত্যজিৎ রায়কেও মানিকদা বলেন।” বিজেপির কর্মীর ‘জহরদা’ সম্ভাষণের সূত্রে তাঁর মনে পড়ছে, “ওঁদের আর কী দোষ দেব, বিশ্বভারতীর উপাচার্য রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব বলেন। প্রধানমন্ত্রী গুরুবর টেগোর বলে থাকেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিমণ্ডলেও এই গণহারে গুরুদেব ডাক নিয়ে বিরক্তি ছিল। গুরুদেব সম্ভাষণ একটি নির্দিষ্ট অন্তরঙ্গ পরিসরের ডাক। এটা যাঁরা বুঝতেন, যেমন অম্লান দত্ত কখনও গুরুদেব বলেননি। কথায় কথায় শ্রদ্ধা নিবেদন বাড়াবাড়ি। আলটপকা দাদা বলাও নিরর্থক।”
ব্রাত্য আবার বলছেন, “এই দাদা ডাকটা সম্ভবত দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অবদান। বরাবরই প্রিয়দা, সুব্রতদা কিন্তু জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবু।” তাঁর ব্যাখ্যা, “ব্রাহ্মরা নিজেদের বাবু সম্ভাষণ করতেন। প্রথম দিকের কমিউনিস্টরা অনেকে ব্রাহ্ম পরিবারভুক্ত। হতেও পারে তাঁরা ব্রাহ্ম ডাকের ঐতিহ্য বহন করেছেন।” দাদার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গীয় আঞ্চলিকতাও বিলক্ষণ টনটনে। বাংলাদেশেই বয়সে অগ্রজ শ্রদ্ধাভাজনকে দাদার বদলে ভাই বলা দস্তুর।
তা হলে আজকের গণ হারে দাদাতন্ত্র কোন পথে টানছে আমাদের?
সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার ব্যথিত, “যাকে-তাকে দাদা ডাকায় ভাষার প্রতিই একটা অবহেলা, তাচ্ছিল্যের ভাব। কাকে কখন কী ডাকতে হবে, তার মধ্যে একটা সংস্কৃতির ছাপ থাকে। হালকা ভাবে দাদার সকলকে একাকার করে আমরা সব কিছুই খেলো করে তুলেছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy