Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Cyclone Yaas

‘চোখের সামনে সব ভেসে গেল’

শ্বশুর হাওড়ায় কাজ করতে এসেছিলেন, লকডাউনে আর ফিরতে পারেননি। তাঁর রেখে যাওয়া ফোন থেকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন পূরবী পাত্র।

মুড়িগঙ্গা নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত ঘোড়ামারা দ্বীপ।

মুড়িগঙ্গা নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত ঘোড়ামারা দ্বীপ। নিজস্ব চিত্র

রবিশঙ্কর দত্ত
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২১ ০৫:২৬
Share: Save:

ঘোড়ামারার খেয়াঘাট থেকে কিছুটা এগিয়ে তেঁতুলতলার কাছে বাড়ি। তারই কাছাকাছি কোনও উঁচু জায়গা থেকে ফোনে তরুণী বধূর গলা ভেসে এল, ‘‘ঘোড়ামারা একেবারে ডুবিছে। চোখের সামনে আমাদের সব ভেসে যাচ্ছে জলে।’’

শ্বশুর হাওড়ায় কাজ করতে এসেছিলেন, লকডাউনে আর ফিরতে পারেননি। তাঁর রেখে যাওয়া ফোন থেকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন পূরবী পাত্র। কিন্তু দানবের মতো আছড়ে পড়া হাওয়ার শব্দে তা চাপা পড়ে গেল আরও অনেক উৎকণ্ঠার সঙ্গে। বছর দেড়েকের শিশুকন্যা, স্বামী আর শাশুড়ির জীবন বাঁচিয়ে আর ফোন ধরতে পারেননি। পারার কথাও নয়।

সুন্দরবনের মধ্যে হলেও মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই দ্বীপের মানুষ ২৪ ঘণ্টা ধরে শুধু প্রাণটুকু বাঁচানোর চেষ্টা করে চলেছেন। হাওয়া আর জলের স্রোত থেকে আড়াল নিতে নিতে বুধবার দুপুরের পরে কিছুটা আত্মসমর্পণের পথই নিয়েছেন এখানকার মানুষ। গোটা দ্বীপ জলের তলায় চলে গিয়েছে। এ বারের ঘূর্ণিঝড় আর কটালের মুখে অসহায় ভাবে এখানকার মানুষ দেখে চলেছেন, তাঁদের সর্বস্ব চলেছে জলের পেটে। খেয়াঘাটের কাছে খুপচি দোকান জহিরুদ্দিনের। সে দোকান উড়ে গিয়ে পড়েছে পাশে একটি পুকুরে।

জলের সঙ্গে লড়াইয়ে অভ্যস্ত ঘোড়ামারা দ্বীপ। নদীর পাড় ভেঙে দু’তিন দশক ধরে ক্রমাগত বদলে গিয়েছে এখানকার চেহারা। একের পর এক গ্রাম চলে গিয়েছে জলের তলায়। বাগপাড়ার বাসিন্দা শুভজিৎ দলুইয়ের কথায়, ‘‘সব জলের তলায় চলে গিয়েছে। স্কুলবাড়ি, বাজার, দোকান, সব। আমরা পাশে একটু উঁচু এক কাকার বাড়িতে এসে উঠেছি।’’

খাসিমারা, বাগপাড়া, পাত্রপাড়া, মন্দিরতলা, চুনপুরী— চার দিক জুড়ে শুধু ঘোলাজল। খাসিমারায় নদীর পাড়ের মাটির বাঁধ ঘেঁষে বাড়ি। পাড় ভাঙার বিপদ তাঁদের শৈশবের সঙ্গী। তবে বুধবার কেঁদে ফেললেন খাসিমারা গ্রামের বাসিন্দা শেখ আফতাবউদ্দিন। ঝড়ের ভয়ে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আফতাবউদ্দিন চলে এসেছেন পাশের দ্বীপ সাগরের বামনখোলায়। ফোনে বললেন, ‘‘আমার ছেলে, বউমা আর নাতিদের কথা ভাবছি। ওঁরা তো গাছে আছে। বউটার শরীর খারাপ। হাসপাতাল বলেছে করোনা হয়নি। তবু করোনা সন্দেহে কাছেও যাচ্ছে না কেউ। এই দুর্যোগে বউটাকে কে দেখবে গো!’’ তার পর ডুকরে উঠলেন সত্তরোর্ধ্ব আফতাবউদ্দিন, ‘‘নিজে বাঁচতে সরে না এলেই ভাল করতাম। ঘোড়ামারা জলের তলায়। আমার পরিজন বড় বিপদে।’’

ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস আসার পর এখান থেকে লোকেদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচার শুরু করেছিল প্রশাসন। জেলা ও স্থানীয় প্রশাসন সেই ব্যবস্থাও করেছিল। কয়েক দফায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সাগরের বামনখালিতে। কিন্তু বেশিরভাগ বাসিন্দাই নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে যাননি। তাঁরা রয়ে গিয়েছেন নিজেদের বাড়িতে। কিন্তু ফের কবে
সেই ঘরবাড়ি বাসযোগ্য হয়ে উঠবে, তা এখন অনিশ্চিত।

খাসিমারা পিরের দরগার পাশ দিয়ে বাঁধের দিকে এগোলে নিতাই ঘড়ুইয়ের পাঁচমিশালির দোকান সিদ্ধেশ্বরী ভাণ্ডার। সেখানে জল উঠেছে মানুষসমান। নিতাইবাবুর ফোন বন্ধ। ছেলে বুদ্ধদেবেরও। টালি-বেড়ার দোকানের কী অবস্থা, তা আঁচ করা যায়। একটি ডুবে থাকা বাড়ির অ্যাসবেসটসের ছাদে বসে সকাল থেকে লোক সামলেছেন। সে সবের খোঁজ সেরে পঞ্চায়েত প্রধান সঞ্জীব সাগর বলেন, ‘‘ঢালাই রাস্তায় পাঁচ-সাত ফুট জল। কোনও বাড়িতে লোক নেই। সবাইকে নিয়ে এসেছি হাইস্কুলের পাশে ফ্লাড শেল্টারে। গবাদি পশুর খোঁজ নেই।’’ ঘোড়ামারার উপপ্রধান ধ্রুব প্রামাণিক হারানোর হিসেব করতে করতে হাঁফিয়ে উঠেছেন। বললেন, ‘‘কিছুই থাকবে না। কিছুই নেই আর আমাদের। গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ভেসে গিয়েছে সবার। সর্বস্ব গিয়েছে।’’

দ্বীপভূমি ঘোড়ামারার প্রাণকেন্দ্র বিশালক্ষ্মীতলা। ন্যাড়া মাঠের একধারে বিরাট মন্দির দেবী বিশালাক্ষ্মীর। বটতলায় আড্ডা বসে। এখানেই বছর বছর দুর্গোৎসবের আয়োজন হয়। মেলা হয়। সেই মাঠে সকাল থেকে কুলকুল করে জল ঢুকেছে। ঘোড়ামারা প্রাইমারি স্কুলের সামনে দিয়ে নদীর দিকে ঢালাই রাস্তা জলের তলায়। বেলা বাড়ার পরে সেখানে নামার সাহস করেননি স্থানীয়দের কেউ। পানের বরজ, সবুজ ধানিজমি, পুকুর, পাটখেত সব জলের তলায়। আমপানের ধাক্কা সামলে মাথা তুলতে চাওয়া ঘোড়ামারার মানুষের সেই চেষ্টা ফের ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে এ বারের ঘূর্ণিঝড় আর সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস। দ্বীপের গর্ব মিলন বিদ্যাপীঠের ছাত্রাবাসের ছাদটুকু জল থেকে মাথা তুলে রয়েছে। একফালি লাল কাপড়ের মতো তা দেখেই সবাই চিনতে চেষ্টা করছেন বলে জানালেন।

শুধু ঘোড়ামারাই নয়, সুন্দরবনের সব ব্লকেরই অবস্থা প্রায় একই রকম। আগে থেকে উদ্ধার করে সরিয়ে আনায় বহু মানুষের প্রাণ বাঁচানো গেলেও নদীবাঁধ মেরামতি-সহ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করতে আরও কিছুটা লাগবে। সাগরের বিডিও সুদীপ্ত মণ্ডল বলেন, ‘‘কিছু জায়গায় মজুত খাবার জলে ভেসে গিয়েছে। সে সব জায়গায় নতুন করে শুকনো খাবার পৌঁছনোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই দুর্যোগে নদীতে যাতায়াত
করা কঠিন।’’

এখানেই শেষ নয়। বিকেল থেকে ফের বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাতে জোয়ারের জল ঢুকতে পারে ভাঙা বাঁধ দিয়ে। রাতের আঁধারে কতদূর আসবে হানাদার, সেই ভাবনায় চোখের জল থমকে আছে ঘোড়ামারার মানুষের। চুনপুরীর বাসিন্দা শেখ শাহজাহানের কথায়, ‘‘আর কিছু যাওয়ার নেই। আমাদের যা ছিল, তা চলে গিয়েছে নদীর পেটে।’’

সারাদিন চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি দ্বীপের স্বাস্থ্য সহায়ক মানস কারককে। অন্ধকার নামার পরে ফোন এল তাঁর। বললেন, ‘‘সব শেষ। জানি না, নতুন করে শুরু করা সম্ভব কি না!’’ বেশি রাতে ফোনে পাওয়া গেল মানসের স্ত্রী শিক্ষিকা চম্পাকেও। বললেন, ‘‘স্বামী, সন্তান কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভাবছিলাম, সব শেষ হয়ে গেল। এখন এই অন্ধকারে স্কুলবাড়িতে দাঁড়িয়ে। বাচ্চাদের মুখে দানা নেই। আবার জোয়ার আসছে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

flood Cyclone Yaas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy