পাথরপ্রতিমার উত্তর গোপালপুর গ্রামের কাছে গোবদিয়া নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত বিস্তীর্ণ এলাকা। ছবি: দিলীপ নস্কর
ত্রাণ শিবিরের সামনে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন সুমিত্রা দাস। একটাই কথা বলছেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। ‘‘ওই রাক্ষুসে নদীটা সব খেয়ে ফেলল!
নড়বড়ে বাঁধটা কেউ সারানোর কথা ভাবল না।’’
বাঁধ মেরামত সময়ে হলে গ্রামের এমন পরিস্থিতি হত না, সকলেই সে কথা বলছেন এক বাক্যে।
কী দাঁড়িয়েছে পরিস্থিতি?
মঙ্গলবার বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে পৌঁছনো গেল পাথরপ্রতিমার গোপালপুর পঞ্চায়েতের উত্তর গোপালপুর গ্রামে। অন্য সময়ে এখানে এসে দেখেছি, খেত ভরা ফসল, গোলা ভরা ধান। এখন যে-দিকে দু’চোখ যায়, সবটাই কোমর সমান জলের তলায়। মাঝে মধ্যে দু’টো একটা বাড়ির কঙ্কাল পড়ে। দোতলা মাটির বাড়িগুলো জলের তোড়ে ধসে পড়েছে। মাথার খড়ের চালটুকু ভাসছে জলে। গ্রামের ভিতরে ইটের রাস্তা কেটে জল বার করার চেষ্টা চলছে কোথাও কোথাও। কেউ কেউ এক চিলতে শুকনো জায়গা খুঁজে প্লাস্টিক টাঙিয়ে আছেন।
তারই মধ্যে জল ঠেলে ঠেলে ভাঙা বাড়ি হাতড়াচ্ছিলেন স্বপন গায়েন। জানালেন, বাঘেরঘেড়ি থেকে আয়লা বাঁধ পর্যন্ত গোবদিয়া নদীর প্রায় এক কিলোমিটার মাটির বাঁধ ভেঙেছে। হুড় হুড় করে জল ঢুকতে শুরু করে গত বুধবার দুপুরের পর থেকে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টিও পড়ছে। কিছু মানুষ আগেই আশ্রয় নিয়েছিলেন ত্রাণশিবিরে। অনেকে ভিটে-মাটি আগলে বসেছিলেন। আশা ছিল, শেষ মুহূর্তে হয় তো ঝড় গতিপথ বদলে নেবে।
আরও পড়ুন: বিদ্যুৎহীন এক লক্ষ, সিইএসসি-র উপর চাপ রাখছে রাজ্য
কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। বরং যা ঘটেছে, তার অভিঘাতে পুরো গ্রাম তছনছ।
হাজার তিনেক লোকের বাস এই গ্রামে। পান, ধান, আনাজ চাষ হয়। অনেকে পুকুরে মাছ চাষ করেন। হাঁস-মুরগির খামার আছে বহু বাড়িতেই। বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে গরু-ছাগলের দড়ি খুলে দিয়েছিলেন প্রায় সকলেই। হাঁস-মুরগির খাঁচাও খুলে এসেছিলেন। গরু-ছাগল কিছু বাঁচলেও মুরগিদের হদিস নেই বলেই জানালেন অনেকেই। কিছু গরু, মুরগির দেহ ভাসতে দেখা গেল জমা জলে।
এ দিকে, সেই জলও পচতে শুরু করেছে এ ক’দিনে। দুর্গন্ধে টেঁকা দায়। কিছু পুকুর থেকে নোনা জল সরলেও সে সব জায়গায় দেখা গেল, জল পচে কালো হয়ে আছে। সুপ্রিয়া পাত্র জানালেন, পুকুরের মাছ আর বেঁচে নেই। গ্রামে ফিরে ফের সংসার বাঁধতে পারবেন, এমন আশাও আর নেই। সুপ্রিয়ার কথায়, ‘‘এখনও জল ঢুকছে গ্রামে। এই অবস্থায় তো বাঁধ সারানোও যাবে না। ফলে কবে জল সরবে, কোনও ভরসা নেই। এখন ত্রাণ শিবিরের খাবারই ভরসা।’’ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন সুপ্রিয়া। বলেন, ‘‘নিজের হাতে রেঁধেবেড়ে কবে বাড়ির লোকগুলোকে দু’টো খেতে দেব, জানি না।’’
গ্রামের যত গাছ ছিল, বেশির ভাগই ঝড়ের দাপটে মাটি নিয়েছে। কিছু ইউক্যালিপটাস, মেহগনি, তেঁতুল গাছ এখনও দাঁড়িয়ে আছে বটে, কিন্তু পাতা সব লাল হয়ে শুকিয়ে এসেছে। গ্রামের লোকজনের মতে, প্রবল ঝড়ে সমুদ্রের নোনা জলের ছিটে লেগে মরতে শুরু করেছে গাছ।
গ্রামের ত্রাণ শিবিরে শ’দুয়েক লোক এখনও আছেন। অনেকে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি চলে গিয়েছেন। যাঁরা আছেন, তাঁদের দেখভালের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী প্রবীরকুমার মাইতি। জানালেন, সরকার চেষ্টা করছে। তাঁরাও নিজেরা ত্রাণ জোগাড় করেছেন বেশ কিছু। গ্রামের লোককে খাবার, জল পরিমাণ মতোই দেওয়া হচ্ছে।
তবে মাটির বাঁধ কেন এখনও কংক্রিটের হল না, তা নিয়ে গ্রামের লোকের ক্ষোভ বিস্তর। পঞ্চায়েতের উপপ্রধান দেবরঞ্জন গিরিও বলেন, ‘‘পঞ্চায়েতের সামান্য তহবিল থেকে এত বড় বাঁধ সারানো সম্ভব নয়। বিষয়টি সেচ দফতরকে একাধিকবার জানিয়েছিলাম।’’ আপাতত রিং বাঁধ করে জল আটকানোর চেষ্টা করা হবে। ত্রাণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে বলে দাবি করেন তিনি।
সুমিত্রাদের অভিজ্ঞতা বলে, বাঁধ সারানো না হলে স্বাভাবিক জীবন কখনওই ফিরবে না। ধানি জমি ছিল তাঁদের। এখন সবই জলের তলায়। কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে সুমিত্রা বলেন, ‘‘ঝড়টা একেবারে পথের ভিখিরি করে দিয়ে গেল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy