বাড়ি মেরামতের চেষ্টা। ধবলাট শিবপুর গ্রাম। নিজস্ব চিত্র
বাসিন্দারা বলছেন, সমুদ্রের উপর দিয়ে বিশাল কালো কিছু ঘুরতে ঘুরতে ধেয়ে আসছিল পাড়ের দিকে। সঙ্গে গোঁ গোঁ শব্দ। সমুদ্রের জল আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে। শব্দে কান পাতা দায়। এক সময়ে কালো বস্তুটা প্রবল শব্দে আছড়ে পড়ল মাটিতে। নিমেষে উড়ে গেল অসংখ্য বাড়ির চাল, মাটিতে শুয়ে পড়ল শ’য়ে শ’য়ে গাছ।
সাগরদ্বীপের ধবলাট পঞ্চায়েতের ধবলাট শিবপুর গ্রাম। বুধবার যেখানে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় আমপান।
তার পর কেটে গিয়েছে পাঁচটা দিন। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সোমবার ঢোকা গেল এলাকায়। কাকদ্বীপের লট-৮ ঘাট থেকে বার্জে মোটরবাইক তুলে মুড়িগঙ্গা পেরোলাম। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার চওড়া সে নদী এখনও ফুঁসছে। সাগরের কচুবেড়িয়া পৌঁছে ফের বাইকে গ্রামের পথ ধরলাম। ইটের ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে যত দূর এগোচ্ছি, যে দিকে চোখ যায়, একটাও মাটির বাড়ির চাল আস্ত নেই। কিছু বাড়ি গোড়া থেকে কেউ যেন উপড়ে ফেলেছে। ইতস্তত পড়ে থাকা টালি খুঁজছেন অনেকে। যদি কোনওটা আস্ত মেলে! মাঠের মধ্যে থেকে অ্যাসবেস্টস, টিনের ছাউনি কুড়িয়ে আনছেন কেউ কেউ।
প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষের বাস ধবলাট শিবপুর গ্রামে। প্রশাসন সূত্রের খবর, পুরো সাগর দ্বীপ জুড়ে ৭৫ শতাংশ মাটির বাড়ি পুরোপুরি ভেঙে গিয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির হিসেব চলছে।
বিঘের পর বিঘে আনাজের খেতও মিশে গিয়েছে মাটিতে। উচ্ছে, বেগুন, টোম্যাটো ছড়িয়ে পড়ে মাঠে। সোমবার দুপুর পর্যন্ত অন্ধকারে ডুবে গোটা এলাকা। ত্রাণের খাবার, জল কিছুই আসেনি। মোবাইলের সিগন্যাল তো অনেক দূরের কথা!
গ্রামের মানুষ জানালেন, বুধবার প্রথমে ঝড় এসেছিল সমুদ্রের উপর দিয়ে, পুব দিক থেকে। ঘণ্টাখানেক বিরতির পরে ফের উল্টো দিক থেকে আছড়ে পড়ে হাওয়া। আর ঘণ্টাখানেক ঝড়টা চললে জোয়ারের সময় চলে আসত। তা হলে বাঁধ ভেঙে আর রক্ষে ছিল না!
আরও পড়ুন: উচ্চচাপের ঠেলাতেই দক্ষিণবঙ্গে আছড়াল আমপান, বলছেন আবহবিদরা
আরও পড়ুন: দুর্ভোগের শেষ নেই, চলছে শুধুই দায় ঠেলাঠেলি
রক্ষা যে খুব হয়েছে, তা-ও নয়। দ্রুততার সঙ্গে রাস্তার উপর থেকে গাছ সরিয়ে ফেলেছে প্রশাসন। তবে অসংখ্য ভাঙাচোরা বাড়ি, দোকান, মুরগির খামার চার দিকে। পানের বরজ মাটিতে শুয়ে পড়েছে। আনাজ খেতের পাশে বসে হা-হুতাশ করছিলেন কঙ্কনা দাস। বললেন, ‘‘টাকা ধার করে চাষ করেছি। সব শেষ। মাথা তুলে দাঁড়ানোর মতো আর অবস্থা নেই আমাদের মতো ছোট চাষিদের।’’
ত্রাণ মেলেনি বলে অভিযোগ আছে সর্বত্রই। কোথা থেকে একটা টুকরো প্লাস্টিক জোগাড় করেছেন সোমাইয়া বিবি। সেটা দিয়ে চাল উড়ে যাওয়া ঘরের একটা দিকে টাঙানোর চেষ্টা করছিলেন। আকাশ এখনও কালো। ঝোড়ো হাওয়া বইছে। তার সঙ্গে যুঝতে পারছিলেন না। বললেন, ‘‘এই হল আমাদের ভবিতব্য। বার বার ঘর ভাঙবে। আর আমরা জোড়াতালি দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাব।’’
বঙ্গোপসাগর, মুড়িগঙ্গা নদী এবং হুগলি নদী ঘেরা সাগর দ্বীপ। ১২ মাস ঝড়-জলের সঙ্গে লড়াই করেই বাঁচেন মানুষ। বড়সড় ঝড় আসার আগে বাড়ির চাল মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা দস্তুর এখানে। সেই প্রস্তুতি মঙ্গলবার সেরে রেখেছিলেন প্রহ্লাদ মাল, দেবব্রত মালেরা। তবু ঝড়ে উড়ে গিয়েছে অ্যাসবেস্টস। ভিটে বাঁচাতে যাঁরা ত্রাণ শিবিরে যাননি, মাঠে শুয়ে পড়েছিলেন তাঁদের সকলেই। দাঁড়িয়ে থাকলে হাওয়ার দাপটে কোথায় যে ছিটকে যেতে হত, বলছেন প্রহ্লাদেরা। হাওয়ার গতি একটু কমলে হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছন ত্রাণ শিবিরে (ভিটের টানে যে শিবির এখন ফাঁকা)। প্রহ্লাদও ঘর সারানোর কাজে হাত লাগান বৃহস্পতিবার থেকে। জানালেন, জলে ভেজা চাল ফুটিয়ে খাচ্ছেন। সরকারি ত্রাণ আসেনি। তবে অক্ষত টিউবওয়েলটা থেকে জলটুকু মিলছে।
কথা হচ্ছিল নর্মদা মালের সঙ্গে। বললেন, ‘‘ঝড়ের রাতে ত্রাণ শিবিরে এক হাতা খিচুড়ি মিলেছিল। তার পর থেকে জলটুকুও পাইনি। ঝড় থামতেই পর দিন সকালে চলে এসেছি বাড়িতে। বাড়ি তো আর কিছুই নেই। প্লাস্টিক টাঙিয়ে আছি।’’ শুকনো জ্বালানি কাঠ জোগাড় করতে ঘাম ছুটছে।
পঞ্চায়েত প্রধানকে বহু বার ফোন করেও যোগাযোগ করা যায়নি এ দিন। ফোন বেজে গিয়েছে। সাগরের বিডিও সুদীপ্ত মণ্ডল দাবি করছেন, ত্রাণ ঠিক মতোই পৌঁছচ্ছে। দেবব্রত, প্রহ্লাদ, নর্মদাদের অবশ্য অভিযোগ, গ্রামে ফিরে তাঁরা ত্রাণ পাননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy