প্রভাতী মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র
দূরত্ববিধির বালাই নেই। সকাল থেকে কয়েকশো মানুষ ঠায় দাঁড়িয়ে শুধু দু’হাতা খিচুড়ির আশায়। অনেকেই বুধবার দুপুরের পর পেট ভরে খেতে পাননি। অপেক্ষা করতে করতে অভুক্ত শিশুরা নেতিয়ে পড়েছে। চার পাশে চাল উড়ে যাওয়া বাড়ি, উপড়ানো গাছ, অজস্র বিষণ্ণ-হতাশ মুখের সারি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলির মালপাড়ায় রবিবার দুপুরে যাঁরা অপেক্ষা করছিলেন, তাঁরা সকলেই যে ওই গ্রামে থাকেন তা নয়। ‘খাবার আসবে’ খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারাও।
কিন্তু কোনও অসহিষ্ণুতা নেই, বরং ভাবটা এমন যেন অনন্ত অপেক্ষাই ওঁদের পাওনা!
ত্রাণ আসেনি? প্রশ্নটা শুনে অনেকেই এমন ভাবে তাকালেন, যেন এমন অদ্ভুত প্রশ্ন কখনও শোনেননি। গোটা এলাকা ঝড়ের পর থেকে বিদ্যুৎহীন। ‘‘ঠিক হতে হতে দেড়-দু’ মাস তো লাগবেই!’’ অবলীলায় বলা কথাটা শুনে অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, ‘‘অত দিন?’’ সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে এক গ্রামবাসী বোঝালেন, ‘‘সে তো লাগবেই! ঝড়টা কী সাংঘাতিক হয়েছিল ভাবুন!’’
আরও পড়ুন: শুকনো চিড়ে কিসে ভিজিয়ে খাব? কোথায় জল?
মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়াটাই মজ্জাগত করে ফেলেছেন এখানকার অধিকাংশ মানুষ। অথচ কলকাতা থেকে জয়নগর পর্যন্ত পৌঁছতেই এ দিন রাস্তায় চার বার অবরোধে গাড়ি আটকেছিল। বিদ্যুৎহীন, জলহীন মানুষ রাস্তায় বসে পড়েছেন। ফুঁসছেন নিষ্ফল রাগে। অথচ কুলতলির এই প্রত্যন্ত এলাকা যেন সেই মানচিত্রের বাইরে। খুন-জখম, ডাকাতি, নারীপাচার, ধর্ষণ, পণের জন্য খুন লেগেই আছে এ তল্লাটে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণ না পৌঁছনো, মাসের পর মাস বিদ্যুৎ না থাকাটাও এখানকার মানুষ যেন ভবিতব্য বলেই মেনে নিয়েছেন।
কিন্তু এ বার ছবিটা বোধহয় বদলাচ্ছে। যাঁর উদ্যোগে বরাবর ‘নিষ্ফলের হতাশের দলে’ থাকা এলাকায় খাবার ও পানীয় জল পৌঁছতে শুরু করেছে, তিনি মালপাড়ার স্কুলশিক্ষিকা প্রভাতী মণ্ডল। নিজেই যোগাযোগ করেছেন বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে। ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়েদের বুঝিয়েছেন, পড়ে পড়ে মার খাওয়ার দিন শেষ। প্রশাসন এগিয়ে না এলে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে। বিপর্যয়ে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তেমনই অনেকে দাঁড়িয়ে পড়েছেন এ ক্ষেত্রেও। নিজেদের সাধ্যমতো তাঁরা একত্র হচ্ছেন। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়েই চলছে এক অসম যুদ্ধ। ওই এলাকায় কমিউনিটি কিচেন খুলতে উদ্যোগী আসানসোলের কলেজশিক্ষক চন্দ্রশেখর কুণ্ডু বললেন, ‘‘আমিও আপ্লুত। এলাকার মানুষ যে ভাবে বললেন, ‘এত দিন আমাদের কথা কেউ ভাবেনি। এ বার নিজেরাই ভাবব। আপনি আমাদের কাকে কী করতে হবে বলুন!’ এই মানসিকতাটাই আসল। আমার অনুমান, কমিউনিটি কিচেনের মডেল হয়ে উঠবে এই এলাকা।’’
আরও পড়ুন: পেয়ারা গাছের ডাল আঁকড়ে সাত ঘণ্টা
বছর ৩৫-এর প্রভাতী বললেন, ‘‘১০ জনের খাবার ২৫ জনে ভাগ করে খেতে রাজি আছি। কিন্তু ভাগ্যের হাতে সব ছেড়ে দিতে রাজি নই। পড়ে পড়ে মার খেতেও রাজি নই।’’ পড়ে পড়ে মার খাবেন না বলেই পণের দাবিতে অত্যাচার চালানো শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছিলেন। ফিরে যাওয়ার কথা ভাবেননি। বললেন, ‘‘আয়লার রাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে যখন আমার মরে যাওয়ার অবস্থা, তখনই ঠিক করেছিলাম, আর নয়। এ বার মেয়েকে নিয়ে বাঁচার রাস্তা খুঁজতে হবে। মেয়ের নাম রেখেছি প্রেরণা।’’
আরও পড়ুন: খুঁটি ধরে দু’ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন পুণ্যলক্ষ্মী
প্রভাতী মনে করেন, আয়লা তাঁর চোখ খুলে দিয়েছিল। আর আমপান শেখাল, বাঁচতে গেলে আশপাশের মানুষকে লড়াইয়ে শামিল করাটাও জরুরি। তাই এ বারের ঝড়ে তাঁর ঘরের চাল উড়েছে, ভেঙেছে ক্লাসঘরের ছাদও। কিন্তু মনোবল চিড় খায়নি। ঘর ভাঙা, চাষের জমি নষ্ট হওয়া, সম্পত্তি ধ্বংস হওয়া মানুষের ঘরে গিয়ে সেই আশার কথাই শোনাচ্ছেন তিনি। বলছেন, ‘‘এমন দুর্যোগ আর আসুক আমরা কেউই চাই না। কিন্তু যদি আসে, তার আগে এলাকার চেহারাটাই বদলে যাবে, দেখবেন!’’ মাথা উঁচু করে এক ভাঙা ঘর থেকে অন্য ভাঙা ঘরের দিকে এগিয়ে যান প্রভাতী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy