বিজেপির অফিসে এল সিপিএম প্রার্থীর ফোন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মঙ্গলবার বেলা সওয়া ৩টে। সল্টলেক সেক্টর ফাইভে বিজেপির নতুন দফতরের তিনতলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের ওয়ার রুমের ফোন বাজল। ফোনকারী পরিচয় দিলেন। নাম শেখ ইমতিয়াজ। পশ্চিম বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বর এলাকার একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রার্থী হয়েছেন সিপিএমের। নিজের দলের হেল্পলাইন নম্বর জানা নেই বলে বিজেপির হেল্পলাইনেই ফোন করেছেন!
ফোন এল ঠিক ৩টে ১৫ মিনিট ২২ সেকেন্ডে। ফোন ধরলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর ঋত্বিক পাল। এর পরের কথোপকথন—
ঋত্বিক: আপনার নাম-পরিচয় দিন।
ইমতিয়াজ: আমার নাম হচ্ছে স্যর শেখ ইমতিয়াজ। পাণ্ডবেশ্বর ব্লকের কেন্দা জিপির (গ্রাম পঞ্চায়েত) ১৮ নম্বর বুথ থেকে আমি সিপিএমের হয়ে দাঁড়িয়েছি।
ঋত্বিক: আপনি সিপিএম থেকে দাঁড়িয়েছেন!
ইমতিয়াজ: হ্যাঁ, সিপিএম থেকে নমিনশন করিয়েছি।
ঋত্বিক: আচ্ছা। এটা কিন্তু বিজেপির হেল্পলাইন নম্বর। তবে আমরা আপনাকে সাহায্য করব।
ইমতিয়াজ: হ্যাঁ স্যর। আমার একটা বন্ধু বিজেপি করে। ও-ই এই নম্বরটা দিয়েছে স্যার।
ঋত্বিক: কোনও অসুবিধা নেই। আপনি যখন এখানে সাহায্য চেয়েছেন, নিশ্চয়ই আমরা সাহায্য করব। বলুন আপনার কী সমস্যা?
ইমতিয়াজ: আমার মোবাইলে বালি মাফিয়া, কয়লা মাফিয়াদের ফোন আসছে। আমার বাবার কাছেও ফোন এসেছে। বাবাকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রেখেছে। শ্বশুরবাড়িতেও লোক গিয়েছে।
আরও বিস্তারিত ভাবে অভিযোগ শোনার পরে ঋত্বিক জানতে চান, সিপিএম নেতৃত্ব বিষয়টি জানেন কি না। ইমতিয়াজ জানান, তিনি স্থানীয় নেতৃত্বকে জানিয়েছেন। পার্টি উদ্যোগ নেওয়ার পর স্থানীয় থানা থেকে পুলিশও তাঁর বাড়িতে এসেছিল। কিন্তু তার পরেও ভয়ের পরিবেশ রয়েছে। নাগাড়ে তাঁর কাছে হুমকি ফোন আসছে। এর পর বিজেপির হেল্প ডেস্কের পক্ষ থেকে ইমতিয়াজকে জানানো হল, পুরো পরিচয় এবং অভিযোগ উল্লেখ করে একটি চিঠি লিখতে হবে। নীচে নিজের সই করে ছবি তুলে পাঠাতে হবে বিজেপির হেল্পলাইন নম্বরে। তার পরে নির্বাচন কমিশন থেকে রাজভবন কিংবা পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো হবে।
বিজেপির হেল্প ডেস্ক থেকেই তাঁর নম্বর সংগ্রহ করে পরে ইমতিয়াজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। প্রথম দিকে ব্যস্ত দেখালেও বিকেল ৪টে নাগাদ থেকে ইমতিয়াজের ফোন সুইচ্ড অফ!
পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের জেলায় জেলায় রাজনৈতিক সংঘাত চলছে। বিরোধীদের অভিযোগ, শাসক তৃণমূল হুমকি দিচ্ছে। বিরোধী দলগুলি নিজেদের মতো করে তা মোকাবিলারও চেষ্টা করছে। প্রার্থীরা দলের জেলা বা রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিযোগ জানাচ্ছেন প্রতিকারের আশায়। অনেকে রাজভবনের ‘শান্তিকক্ষ’-এও ফোন করছেন। কিন্তু সিপিএম প্রার্থীর (তা-ও আবার সংখ্যালঘু প্রার্থী) জেনেশুনে বিজেপির দফতরে ফোন করে সাহায্য চাওয়ার ঘটনা বিরল। শাসক তৃণমূল অবশ্য এর মধ্যে ‘বিরল’ কিছু দেখছে না। তাদের মতে, এর থেকেই স্পষ্ট যে, বামের সঙ্গে রামের আঁতাঁত রয়েছে। তবে পঞ্চায়েতের মতো স্থানীয় স্তরের ভোটে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব সমস্ত সমীকরণও দেখা যায়। তবে সেটা বেশি হয় ভোটের পরে ত্রিশঙ্কু বোর্ড হলে। তখন পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলের বিজয়ীদের জোট গড়ে পঞ্চায়েত গঠন করতে হয়। অতীতে এর বহু উদাহরণ দেখা গিয়েছে।
এ বার পঞ্চায়েত ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পর থেকেই প্রধান বিরোধীদল বিজেপি রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তাদের প্রার্থীদের হুমকি দেওয়া বা মনোনয়নে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলছিল। সে সব অভিযোগ নথিবদ্ধ করতে এবং সাধ্যমতো তার সুরাহা করতেই সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের নতুন দফতরের তিন তলায় ওই ওয়ার রুম খোলা হয়েছে। সেখানেই একটি বড় হলঘরে বসেছেন হেল্প ডেস্কের কর্মীরা। তাঁদের নেতৃত্বে রয়েছে অতীতে ডায়মন্ড হারবার লোকসভা আসনে বিজেপির হয়ে ভোট-লড়া অভিজিৎ দাস। গেরুয়া শিবিরে যিনি ‘ববিদা’ নামে পরিচিত। হেল্পলাইন সামলানোর জন্য গঠিত কমিটিতে প্রাক্তন আইপিএস ভারতী ঘোষ থেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর ঋত্বিক পাল-সহ অনেকে রয়েছেন। কেউ রাজভবনের সঙ্গে, কেউ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সম্পর্ক রাখছেন।
হেল্প ডেস্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা অভিজিৎ বলেন, ‘‘নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পর দিন থেকেই আমরা এই নম্বর চালু করেছি। ইতিমধ্যেই এক হাজারের বেশি ফোন এসেছে।’’ কী ধরনের ফোন আসছে? অভিজিৎ বলেন, ‘‘বেশিটাই সন্ত্রাসের অভিযোগ। আমরা সবই রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে ইমেল মারফত জানাচ্ছি। রাজভবনে শান্তিকক্ষ খোলার পরে সেখানেও অভিযোগ পাঠাচ্ছি। সঙ্গে আক্রান্তদের ছবি আর ভিডিয়োও পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’ তাতে কাজের কাজ হচ্ছে কী? অভিজিতের জবাব, ‘‘অনেক সময়েই পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। ঘটনাস্থলেও যাচ্ছে। কিন্তু সেটা এতটাই দেরিতে যে, লাভ হচ্ছে না। আমরা তাই কোনও কোনও ঘটনার কথা জরুরি ভিত্তিতে সরাসরি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। প্রথম দিকে না হলেও এখন কমিশনের পক্ষে ইমেল করে জানানো হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’
হেল্পলাইন নম্বর চালুর পরে প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা অবশ্য ভাল ছিল না বিজেপির। নানা রকম ভুয়ো ফোনও এসেছে। আবার আমপানের ক্ষতিপূরণ না-পাওয়া বা আবাস যোজনায় বাড়ি না-পাওয়ার অভিযোগও এসেছে। তবে হেল্পলাইন নম্বরটি পঞ্চায়েত নির্বাচন সংক্রান্ত হলেও অন্য অভিযোগও নথিভুক্ত করে রাখছে বিজেপি। তবে কোনও সিপিএম প্রার্থীর ফোন যে আসবে, সেটা ভাবেননি বিজেপির এই বিভাগের নেতা-কর্মীরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy