তপ্ত বৈশাখে ব্রিগেড। মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। তবে সেই ব্রিগেডের মেজাজ রইল রবিবাসরীয় দুপুরের রোদের মতোই বেশ কিছুটা নরম, মিয়ানো। শেষ বার ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআইয়ের ডাকা ব্রিগেড সমাবেশে দাঁড়িয়ে ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য জনপ্রিয় হিন্দি ছবির সংলাপের আদলে বলেছিলেন, “বাপ কো হাত লাগানে সে পহেলে, বেটে সে বাত করনা পড়েগা!” এ বার গুরুজনদের ব্রিগেডে ‘বেটা’রা ছিলেন কার্যত আড়ালে। কিন্তু দল বা ফ্রন্টের নাম বাদ রেখেও যে ভাবে ১৫ মাসের মধ্যে দু’বার ব্রিগেড ভরাল সিপিএম, তাতে সামনের বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে স্বস্তি খুঁজতেই পারে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।
গত বারের ব্রিগেড ছিল ‘যৌবনের ডাকে জনতা’র ব্রিগেড। কার্যত ‘নিয়ন্ত্রকে’র ভূমিকায় ছিল বাম ছাত্র-যুবরা। কিন্তু এ বারের ব্রিগেড ছিল মেহনতি মানুষের। সেখানে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুর ও বস্তিবাসীদের নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠনের নেতৃত্ব। শহর ও শহরতলি থেকে আসা যুব প্রজন্মকে সামনে রেখে অন্যান্য ব্রিগেডে আক্রমণাত্মক, প্রাণোচ্ছ্বল মেজাজ থাকে। এই ব্রিগেডে সেই মেজাজ চোখে পড়েনি। ব্রিগেডে এ দিন বক্তারা মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছেন। ডেউচা-পাঁচামিতে আদিবাসীদের জমি ‘কেড়ে’ নেওয়ার অভিযোগ থেকে শ্রম কোডের মতো ‘শ্রমিক স্বার্থ-বিরোধী’ বিষয়গুলি উঠে এসেছে। বক্তারা তথ্য দিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের জন-বিরোধী নীতির সমালোচনা করেছেন। উঠে এসেছে আর জি কর-কাণ্ড থেকে নিয়োগ-দুর্নীতিতে রাজ্য সরকারের ভূমিকার সমালোচনা। কিন্তু অন্য ব্রিগেডের উচ্ছ্বাসের তুলনায় এ দিনের সমাবেশ ছিল সংযত।
সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, তারা সচেতন ভাবেঅ এ বার ব্রিগেড সমাবেশের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছে। ছাত্র-যুবদের সামনে রেখে যে চেনা চেহারা নানা সভা-সমাবেশে দেখা যায়, তার বাইরে গিয়ে কৃষক, শ্রমিক-সহ দলের শ্রেণি ভিত্তির কাছে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে। তাই আঙ্গিকে, মেজাজে বদল এসেছে তার সঙ্গেই। তবে জীবন-যুদ্ধে জর্জরিত যে বাম জনতা ব্রিগেডে এসেছে, তাদের সংশয়ও ধরা পড়েছে আলাপচারিতায়। পূর্ব বর্ধমানের কৃষক হোন বা পশ্চিম মেদিনীপুরের শ্রমিক, প্রায় সমস্বরেই তাঁরা বলেছেন, ‘‘গ্রামে গ্রামে তৃণমূল কংগ্রেস কত টাকা খরচা করছে, সেই সঙ্গে বিজেপিও। আর চলছে শুধু হিন্দু-মুসলিমে ভাগাভাগি। এর সঙ্গে আমরা কি পারব?’’ ভালবেসে করা দলের ডাকে তাঁরা ব্রিগেডে এসেছেন ঠিকই তবে লড়াইয়ের দিশা খুঁজে বেড়ানোর অসহায়তাও তাঁদের কথায় ধরা পড়েছে।
বক্তাদের এ দিনের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় মেরুকরণ ও বিভাজনের চেষ্টার অভিযোগে। ব্রিগেডের ভিড় যে শেষ পর্যন্ত ভোট-বাক্সে প্রভাব ফেলে না, এই অভিজ্ঞতা গত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে বামেদের হয়েছে। ব্রিগেড থেকে এ দিন অন্তত দু’জন বক্তা সেই বিষয়টিকে তুলে জনতাকে বুঝিয়েছেন, ভোটের রাজনীতি এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যন্ত্রণার প্রশ্ন নিয়ে আন্দোলন পৃথক বিষয়। কিন্তু ভোটের ঝুলি ফাঁকা থাকলে এই বাজারে আন্দোলনে উৎসাহ থাকবে কি না, সে প্রশ্ন বাম শিবিরেই আছে।
কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসক দল যথারীতি সিপিএমকে বিঁধেছে। তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের মন্তব্য, ‘‘একটা ব্রিগেড, এক দিনের সমাবেশ দিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে পড়ে না, শুয়ে পড়ে না, বসে পড়ে না! সিপিএম আগেও ব্রিগেড করে বলেছিল, ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। তৃণমূল তো কমেনি। কমেছে সিপিএম। আর তার ভোট নিয়ে বিজেপি বেড়েছে। আজ যাঁরা ব্রিগেড গেলেন, তাঁদের ৯৯% ভোট দেবেন বিজেপিকে।’’ বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি, সদ্যবিবাহিত দিলীপ ঘোষের কটাক্ষ, ‘‘এই রাজ্যে যেমন দুর্গাপুজো, কালীপুজো হয়, তেমন বছরে এক বার বামেদের ব্রিগেড হয়! যা-ই করুক, ফল ওটাই হবে! কারণ, মানুষ ওঁদের ভুলে গিয়েছে।’’
ফলের কথা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে ব্রিগেড থেকে প্রান্তিক বাম কর্মী-সমর্থকদের লড়াইয়ের দিশা নিয়ে ফেরার আশা মিটল কি!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)