আর জি করের পরে যাদবপুর। রাজ্যে পরপর প্রতিবাদী আন্দোলনে মিলে যাচ্ছে বাম এবং অতি বাম নানা সংগঠন। ‘বৃহত্তর স্বার্থে’র কথা বলে পারস্পরিক মতপার্থক্য সরিয়েই অন্যান্য বাম দল ও সংগঠনের পাশে মিলিত পদক্ষেপের কৌশল নিয়ে চলছে সিপিএম। ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে বামপন্থী ভাবনার যে প্রভাব রয়েছে, বাম শক্তিকে সংহত করে তাকে ধরতে চাওয়াই তাদের লক্ষ্য। ভোটের বাক্সে তার কোনও প্রভাব পড়বে কি না, সে উত্তর অবশ্য স্পষ্ট নয়। বাম ও অতি বামের এই ‘আঁতাঁত’কে আবার পাল্টা নিশানা করে ঐক্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি।
দলীয় স্তরে সিপিএমের সঙ্গে বামফ্রন্টের বাইরের দলগুলির খুব বেশি যৌথ কর্মসূচি এখনও চোখে পড়ছে না। তবে ছাত্র, যুব বা কখনও চিকিৎসকদের সংগঠনে বিভিন্ন বাম শক্তি এক জায়গায় এসে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর জি কর-কাণ্ডে যে ছবি দেখা গিয়েছিল, তারই অনেকটা পুনরাবৃত্তি হচ্ছে যাদবপুর-কাণ্ডে। যেমন, গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে সংহতির বার্তা দিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইন্দ্রানুজ রায়কে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর গাড়ির ধাক্কায় যে ইন্দ্রানুজ জখম হয়েছেন বলে অভিযোগ, অতীতে মাওবাদী তত্ত্বের সমর্থনে বা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পরে তাঁর কড়া সমালোচনায় ওই ছাত্রের করা নানা মন্তব্য সামনে এনে সিপিএমকে আক্রমণে নেমেছে তৃণমূল। সুর মেলাচ্ছেন পিডিএসের মতো বামপন্থী পরিচয়ের কিছু দলের নেতারাও। সিপিএম অবশ্য বলছে, জেনে-বুঝেই তারা ওই কাজ করেছে।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক ‘নকশালপন্থী’ ছাত্রকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার পরে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ মন্তব্য করেছেন, “সেলিম বুদ্ধবাবুকেও জলাঞ্জলি দিয়ে ছবি তুলে ভেসে থাকতে গিয়েছেন!” সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং এসএফআইয়ের সর্বভারতীয় নেতা সৃজন ভট্টাচার্য হাসপাতালে গেলে তাঁকেও একই ভাবে নিশানা করেছেন কুণালেরা। সেলিমের ব্যাখ্যা, ‘‘এই ভাবে ধাক্কায় কেউ আহত হলে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায় অথবা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়। আমরা পাশ কাটিয়ে চলে যাইনি। অন্যায়ের প্রতিবাদে পাশে দাঁড়িয়েছি।’’
তৃণমূল ও বিজেপির তোলা ‘মাওবাদী আঁতাঁতে’র অভিযোগেরও জবাব দিয়েছে সিপিএম। তাদের বক্তব্য, মাওবাদী কোনও কর্মসূচির সমর্থনে তারা যায়নি। নির্দিষ্ট অন্যায়ের প্রতিবাদে যাওয়া হয়েছে। সেলিমের কথায়, ‘‘রাজ্যে মাওবাদীদের ডেকে এনে আঁতাঁত করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। নন্দীগ্রামের নানা খুনের মামলা আবার শুরু করতে বলেছে হাই কোর্ট। ঠিকমতো তদন্ত হলে মুখ্যমন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, দু’জনেরই অতীতের কীর্তি সামনে আসবে। এ সব বলে ওঁরা এখন নজর ঘোরাতে চাইছেন।’’ সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, ভোটের বাক্সে তৃণমূল ও বিজেপি অনেক এগিয়ে থাকলেও ছাত্র-যুব সমাজের উপরে বাম প্রভাবে দু’পক্ষই উদ্বিগ্ন। তাই বাম সমন্বয়কে তারা আক্রমণ করছে।
বিজেপি-আরএসএস শিবির যাদবপুরে বামেদের ‘শিক্ষা’ দিতে হুঙ্কারের সুরই বজায় রেখেছে। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এর আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্জিকাল স্ট্রাইকের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। অনেকটা সেই সুরেই সঙ্ঘের ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র রাজ্য সম্পাদক অনিরুদ্ধ সরকার মঙ্গলবার এসএফআইকে আক্রমণ করে বলেছেন, “আগামী দিনে যাদবপুরের ভিতরে বিদ্যার্থী পরিষদ সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করবে এবং সেটা খুব ভয়ঙ্কর! যে সংগঠন যে ভাষা বোঝে, আগামী দিনে বিদ্যার্থী পরিষদ তাকে সেই ভাষাতেই জবাব দেবে।” এবিভিপি-র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটের সভাপতি নিখিল দাসের দাবি, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী বাম, অতি বাম ও নকশালদের সঙ্গে ‘সেটিং’ করে একে অপরের পরিপূরক হতে চাইছেন।’’ এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক দেবাঞ্জন দে অবশ্য বলেছেন, ‘‘এক ইঞ্চিও জমি ছাড়বে না এসএফআই। ক্যাম্পাসে দুষ্কৃতী-রাজ খতম করতে লড়াই চলবে শেষ তক।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)