রাজ্যে তুঙ্গ লড়াই। জাতীয় স্তরে আবার একই মঞ্চে পাশাপাশি। বিজেপি-বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সহাবস্থান প্রসঙ্গে দলের অন্দরের বিভ্রান্তি কবুল করে নিল সিপিএম। তবে বিজেপি-বিরোধিতার লক্ষ্য মাথায় রাখলে সেই বিভ্রান্তি যে অন্তরায় হওয়া উচিত নয়, দলের আসন্ন রাজ্য সম্মেলনের রাজনৈতিক প্রতিবেদনে সেই বার্তাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব। তারই পাশাপাশি, নানা প্রশ্নে পথে নেমে দলের দৃশ্যমানতা বাড়ানো গেলেও ‘জঙ্গি শ্রেণি আন্দোলন’ এখনও গড়ে তোলা যাচ্ছে না বলে উদ্বেগও ধরা পড়ছে সম্মেলনের আবহে।
হুগলি জেলার ডানকুনিতে আগামী ২২ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি হতে চলেছে সিপিএমের ২৭তম রাজ্য সম্মেলন। উদ্বোধন করার কথা দলের পলিটব্যুরোর কো-অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাটের। রাজ্য সম্মেলনের জন্য খসড়া রাজনৈতিক প্রতিবেদনেই বিজেপি-বিরোধী সর্বভারতীয় মঞ্চের প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ইন্ডিয়া’ ব্লকে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে থাকা দলের একাংশের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে’। তবে একই সঙ্গে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য সংক্রান্ত ধারণায় অস্পষ্টতার কারণেই এই ‘বিভ্রান্তি’ হয়েছে। রাজনৈতিক লক্ষ্য ও কৌশলের সূত্রেই খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তৃণমূলকে বড় বিপদ, বিজেপিকে ছোট করে দেখার প্রবণতা একাংশের মধ্যে আছে’।
বাংলায় শাসক তৃণমূলের বিরোধিতা করলেও সিপিএম ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চে তাদের সঙ্গেই শরিক, এই তথ্যকে হাতিয়ার করে এ রাজ্যে সরব বিজেপি। ‘দিল্লিতে দোস্তি, বাংলায় কুস্তি’র কটাক্ষ করে বিজেপি নিজেদেরই প্রকৃত তৃণমূল-বিরোধী শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে তৎপর। এই প্রচারের প্রভাব দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে কাজ করেছে বলে গত লোকসভা নির্বাচনের পর্যালোচনা রিপোর্টেই মেনে নিয়েছিল সিপিএম। বাংলায় তৃণমূল ও কেরলে কংগ্রেসকে নিয়ে দলের দুই রাজ্য শাখার অস্বস্তির কারণে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের সমন্বয় কমিটিতে সিপিএম যোগ দেয়নি। দলীয় বৈঠকে সিপিএমের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, অধুনা প্রয়াত সীতারাম ইয়েচুরি ‘ইন্ডিয়া’ প্রশ্নে বিভ্রান্তি কাটাতে একাধিক বার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তবে সেই বিভ্রান্তি ও অস্বস্তি যে দলের মধ্যে রয়েই গিয়েছে, রাজ্য সম্মেলনের প্রতিবেদনে তা বুঝিয়ে দিয়েছে সিপিএম।
নানা মহল থেকে বারবারই সিপিএমের দিকে অভিযোগ উঠেছে, বাংলায় তৃণমূলের বিরোধিতায় তারা যত সরব, বিজেপির ক্ষেত্রে ততটা নয়। দলীয় নেতৃত্ব বারবার সে অভিযোগ খণ্ডন করলেও ওই প্রবণতার কথা মেনে নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিবেদনে। তবে দলের রাজনৈতিক লাইনে কোথাও যে আপস করার প্রশ্ন নেই, তার ব্যাখ্যাও সেখানে আছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলের স্বৈরাচার বা দুর্নীতি নিয়ে আমাদের দলের অবস্থান পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্টেও স্পষ্ট বলা হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা বলতে চাইছি, রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে সব রকমের লড়াই করেও জাতীয় স্তরে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চে কোনও ছুৎমার্গ রাখা হয়নি। সেটা করা হয়েছে বিজেপিকে বড় বিপদ মনে করি বলেই।’’
সাম্প্রতিক অতীতে আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ, ডিওয়াইএফআইয়ের ‘ইনসাফ যাত্রা’, যুব সংগঠনের ডাকে ব্রিগেড সমাবেশ— এ সবই যে দলের ‘দৃশ্যমানতা’ বাড়িয়েছে, সেই প্রসঙ্গ আছে প্রতিবেদনে। সেই সঙ্গেই বলা হয়েছে, ‘জঙ্গি শ্রেণি আন্দোলনের স্তরে উন্নীত হতে হবে’। শ্রেণি আন্দোলন শক্তিশালী না-হলে গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের আস্থা অর্জন করা কঠিন। নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় সংগঠনকে প্রসারিত করার নতুন জায়গা এসেছে বলেও বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। শ্রমিক সংগঠন সেই কাজ অনেকটা করতে পারলেও গ্রামীণ, প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছনো যাচ্ছে না সে ভাবে। সেই কারণেই গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষকে নিয়ে সার্বিক সংগঠন তৈরির প্রস্তাব ফের তোলা হয়েছে। এর আগে দলের প্লেনামেও এমন ভাবনা এসেছিল আলোচনায়।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)