অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
জাঁদরেল স্বভাবের বলেই তাঁকে জানে সবাই। তিনি কয়লাখনি এলাকার মহিলা বিধায়ক। বাড়িতে এবং দলীয় কার্যালয়ে বেশ কয়েক বার শাসক দলের হামলার অভিযোগ উঠেছে। সে সব মোকাবিলা করেই চালিয়ে যাচ্ছেন চার বছর। কাউকে ভয় পান বলে কেউ কোনও দিন শোনেনি। উল্টে নিজের দলের শীর্ষ নেতৃত্বকেই প্রয়োজনে দু-চার কথা শুনিয়ে দিতে পারেন!
সেই তিনিই কি না কথা নেই-বার্তা নেই, বুধবার বিধানসভায় ঘেমেনেয়ে অসুস্থ হয়ে একাকার!
সতীর্থ বিধায়কদের হাঁকডাক, চিকিৎসকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থামার পরে শেষ পর্যন্ত সেটাই হল বিধানসভায়, চলতি কথায় যাকে বলে আলমারি থেকে কঙ্কাল বেরিয়ে পড়া! চিকিৎসকেরা বলছেন, থাইরয়ে়ডের রোগী, জামুড়িয়ার সিপিএম বিধায়ক জাহানারা খানের রক্তচাপ বেড়ে গিয়েই বিপত্তি বেধেছিল। কিন্তু জাহানারা জানাচ্ছেন, রক্তচাপ ঊর্ধ্বগামী হওয়ার পিছনে আসলে কঙ্কাল!
সে আবার কেমন কথা!
জাহানারা বলছেন, ‘‘রাতে একা থাকি। শুতে যাওয়ার আগে খবরের চ্যানেল দেখার অভ্যাস। কয়েক দিন ধরে যে চ্যানেলই ধরছি, শুধু কঙ্কাল আর কঙ্কাল! একটু চোখ বন্ধ করলেই ওই দাঁত বেরিয়ে থাকা মুখটা দেখতে পাচ্ছি! মনে হচ্ছে, হাড় বেরিয়ে আছে!’’ চোখ বুজলেই কঙ্কালের ছায়া দেখে আতঙ্কিত জাহানারা কয়েক রাত ঘুমোতে পারেননি। তার জেরেই এ দিন অধিবেশন চলাকালীন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
সাহসিনী বলেই এত দিন যাঁকে চিনে এসেছেন, তাঁর হঠাৎ ওই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন সিপিএমের অন্য বিধায়কেরাও। এস এম শাদি, নাজমুল হকেরা জাহানারাকে বিধানসভার চিকিৎসকদের কাছে নিয়ে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করান। একটু ধাতস্থ হয়ে জাহানারা বলেছেন, ‘‘টিভিতে দেখছি, একটা বাড়িতে মাসের পর মাস কঙ্কাল নিয়ে একটা লোক থাকত। কোনও গন্ধ নাকি সে পেত না! এটা আবার হয় নাকি! চোখ বুজলে আমার নাকেই যেন পচা গন্ধ এসে লাগছে মনে হচ্ছে!’’ জাহানারার গল্প শুনে হাঁফ ছেড়েছেন দলীয় বিধায়কেরা। বড়সড় কিছু তা হলে হয়নি! রাতে আপাতত কয়েকটা দিন খবরের চ্যানেল না দেখার পরামর্শ তাঁরা দিয়েছেন জাহানারাকে। আর জাহানারা জানিয়েছেন, তেমন ভয় পেলে বিধায়ক আবাসে দলের সতীর্থ মমতা রায়কে ডেকে নেবেন।
শহরের মনোবিদেরা কিন্তু জানাচ্ছেন, জাহানারা যে আতঙ্কে ভুগছেন, তা যেমন বিরল নয়, তেমনই হাসিঠাট্টার বিষয়ও নয়। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, ‘‘যে বিষয়গুলো হজম করতে অসুবিধে হয়, যে রকমটা কখনও হতে পারে না বলেই অধিকাংশ মানুষ মনে করে এসেছেন, সেটাও যে হতে পারে— এই বোধটাই নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।’’
এর ফলে মানসিক ধাক্কা এবং তার জেরে অসুস্থতা স্বাভাবিক বলেই তাঁর বিশ্লেষণ। আর এক মনোবিদ মোহিত রণদীপ জানাচ্ছেন, খুব ডাকসাইটে মানবাধিকার কর্মী বা পুলিশ, যাঁরা কোনও কিছুতেই ভয় পান না, অথচ ট্রেনে উঠলে অসুবিধেয় পড়েন— এমন নজিরও আছে। তাঁর কথায়, ‘‘কোন মানুষ কোন জিনিসে প্রভাবিত হবেন, আগে থেকে ধারণা করা যায় না। কঙ্কালে কেউ ভয় পেতে পারে। যে ভাবে সংবাদমাধ্যম রবিনসন স্ট্রিটের ঘটনাকে তুলে ধরছে, কেউ কেউ ভূতুড়ে মিউজিকও চালাচ্ছে, তা অনভিপ্রেত ও নিন্দাজনক। এটা একেবারেই সুস্থ নয়!’’
কঙ্কাল-কাণ্ডের ধাক্কা যে সুস্থ নয়, মানছেন জাহানারার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীরাও। সিপিএম বিধায়ক সুশান্ত ঘোষ বিধানসভায় ঢুকলেই এই সে দিনও ‘কঙ্কাল, কঙ্কাল’ করে যাঁরা চিৎকার করতেন, সেই দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় (এমনিতে রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল-কাণ্ডের অন্যতম কুশীলবের সঙ্গে নামের মিলের জেরে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে তীব্র রসিকতার ঝ়ড় উঠেছে, তাতে সহাস্য বিড়ম্বনায় আছেন শিক্ষামন্ত্রী) পর্যন্ত বলছেন, ‘‘এটা শুধু জাহানারার সমস্যা নয়। শিক্ষিত ছেলে, ১৪ তলার ফ্ল্যাটে থাকে, সে-ও বলছে একা থাকতে ভয় করছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা অবশ্যই আছে। কিন্তু কঙ্কাল নিয়ে এই অতি উৎসাহ বৃহত্তর স্বার্থে বন্ধ হওয়া উচিত!’’
মন্ত্রী পার্থের আবেদনে রবিনসনের পার্থ-কাহিনি কি বন্ধ হবে? রাতে ঘরে ফিরেই আতঙ্কের প্রহর গুনছেন জাহানারারা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy